লোকসংস্কৃতির গভীরে আছে এক সৃজনশীল সচল সত্তা। এই সত্তার গভীরে থাকে গ্রামীণ মানুষের সৃষ্টিধর্মিতার সত্যিকারের পরিচয়। পরিচয়টি পেতে হ’লে চাই নির্মোহ অনুসন্ধিৎসা। আগ্রহের ঐকান্তিক উদারতা। বিচার বিশ্লেষণের জন্য বিজ্ঞানসম্মত যুক্তিবাদিতা। লোক সংস্কৃতিকে দেখতে হবে তার স্বভাবের সামগ্রিকতায়, টুকরো টুকরো করে দেখতে গেলে তাকে পাওয়া যায় না।
কারণ Culture is used in a very wide sense’। শুধু তাই নয়, নৃতাত্ত্বিকেরা মনে করেন ‘Culture’ শব্দটি Whole field of human life’-কে ‘Cover’ করে। এই জন্যই দেখা যায়, লোকসংস্কৃতির বড় বিশেষত্ব হচ্ছে সর্বজনগ্রাহ্যতা। সমবেত আবগে, আকাঙক্ষা ও আগ্রহের ভেতর দিয়ে গড়ে ওঠে লোক-সংস্কৃতির সৃজনশীলতা। এইখানেই লোকসংস্কৃতির সর্বজনস্বীকৃতির ইতিকথা।
নির্দিষ্ট একটি ভৌগোলিক সীমারেখায় লৌকিক সাহিত্যের প্রান্তসীমা চিহ্নিত করা যায় না। কারণ দীর্ঘ ঐতিহ্যে প্রাণিত, দীর্ঘকাল প্রবাহিত সংস্কৃতির একটি নিজস্ব আদল তাকে যাকে বলতে পারি একটি সাংস্কৃতিক পরিকাঠামো বা পরিমন্ডল। এই পরিমন্ডলের পেছনে থাকে ইতিহাস, পুরাণ, ভূগোল। সব মিলিয়ে বলা যায়, অখন্ড জীবনচর্যার মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠে লোকায়ত সংস্কৃতির গতিপ্রকৃতি, গাছপালা, ফুল-ফল। এটিই হল একটি এলাকার ‘ঈঁষঃঁৎধষ ঝবঃঃরহম’। এই কারণে প্রয়োজন : ভৌগোলিক পরিচিতি।
জনগোষ্ঠী পরিচিতি :
ইতিহাসগত পরিচিতি : পৌন্ড্রবর্ধন-কোটিবর্ষ-দেবকোট প্রভৃতির প্রেক্ষাপটে দিনাজপুর ও সংলগ্ন এলাকার বিকাশ-বিবর্তন।
সাবেক দিনাজপুরের একটি ছোট অংশ উত্তর দিনাজপুর। বিপুল শিল্পসম্পদে সমৃদ্ধ এই এলাকা, ইতিহাসে আছে তার অজস্র পরিচয়।
লোকায়ত সংস্কৃতির অনেকগুলি শাখা :
বস্তুকেন্দ্রিক লোকসংস্কৃতি
অঙ্কন ও লিখনকেন্দ্রিক লোকসংস্কৃতি
অঙ্গভঙ্গীকেন্দ্রিক লোকসংস্কৃতি
বিশ্বাস ও সংস্কারমূলক লোকসংস্কৃতি এবং
বাক্কেন্দ্রিক লোকসংস্কৃতি।
বস্তুকেন্দ্রিক শাখার অন্তর্ভুক্ত ছড়া-ধাঁধা-প্রবাদ-গীতি-লোককথা-লোকনাটক এবং এলাকার বসবাসকারী মানুষের মুখের বচন অর্থাৎ মৌখিক কথ্য বচন, এগুলিই হচ্ছে বাক্কেন্দ্রিক লোকসংস্কৃতির প্রধান পরিচয়। এসবই হচ্ছে লৌকিক সাহিত্য। আমাদের বর্তমান লক্ষ্য হচ্ছে, উত্তরদিনাজপুরের এই লৌকিক সাহিত্যের আর্থ-সামাজিক পটভূমির অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণ। সংস্কৃতির বিচার-বিশ্লেষণ ও অনুসন্ধানের জন্য কিছু কিছু পদ্ধতির আশ্রয় নেওয়া হয়ে থাকে। পদ্ধতিগুলির মধ্যে আর্থ-সামাজিক পদ্ধতির গুরুত্ব অনেক বেশী। যুক্তিবাদী মানুষেরা মনে করেন আমাদের বিশ্বপ্রকৃতির, এই পৃথিবীর অস্তিত্বের সঙ্গে মানুষের চিন্তাভাবনার সম্পর্ক বেশ গভীর। পৃথিবীর বাস্তব অস্তিত্ব ও চিন্তভাবনার সম্পর্ক বিচার করতে গিয়ে অনেকে বস্তুবাদী দর্শনের কথা বলেছেন। বস্তুবাদী দর্শনের সূত্র ানুসরণ করে বলা যায় যে, সৃজনশীল সাহিত্য সংস্কৃতির সঙ্গে সমাজের সমস্ত স্তরের মানুষের নিবিড় সংযোগ আছে। খুব সংক্ষেপে বলতে পারি, সমস্ত সমাজের বিকাশ-বিবর্তনের ধারায় আছে অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-দার্শনিক ভিত্তিভূমি। এই ভিত্তিভূমির প্রভাবে মানুষের জীবনচর্যার রূপরীতি তৈরি হয়। এই রূপরীতির ধরন-ধারণ অনুযায়ী মৌলিক সংস্কৃতির আদল ও তার রূপান্তর হতে থাকে। কারণ অসমান সমাজ-সংগঠনে নিরন্তর কিছু দ্বন্দ্ব-সংঘাত ঘটতে থাকে। এই দ্বন্দ্ব-সংঘাত লৌকিক মানসিকতায় অনেক রকম অভিঘাত সৃষ্টি করে। এই অভিঘাতগুলি ছড়া-ধাঁধা-প্রবাদ-গীতে প্রতিফলিত হয়। প্রতিফলনের কারণ খুবই স্পষ্ট। কারণ হচ্ছে বাস্তব অবস্থান। সামাজিক-বাস্তবিক অবস্থান এই জীবনযাপনের অভ্যাস, নিয়মনীতি এবং উৎপাদন-ব্যবস্থার প্রকৃতির সঙ্গে লোক-সংস্কৃতির সম্পর্ক নিবিড়। নিবিড় এই সম্পর্কের জন্যই মানুষের ক্রোধ-লোভ-বেদনা-লাঞ্ছনা বাদ-প্রতিবাদ, স্বপ্ন, স্বপ্নভঙ্গের অভিব্যক্তি ঘটে লোকসাহিত্যে। এই দ্বন্দ্বগুলিই হল আর্থ-সামাজিক দ্বন্দ্ব। এই জন্যই এই আর্থ-সামাজিক পদ্ধতির গুরুত্ব বেশী।
দু-একটি ধাঁধা দেখা যাক :
‘বড় ডিঘিটাত্ একেটায় পুঁটি মাছ’।
বড় একটি দিঘি। সেই দিঘিতে একটিমাত্র পুঁটিমাছ। ধাঁধাটির উত্তর হচ্ছে ‘চান’ বা ‘চাঁদ’। সাধারণ অভিজ্ঞতায় লোকায়ত কাল্পনিকতার একটি ছবি এখানে পরিস্ফুট। বিশাল আকাশ এবং রুপোলি চাঁদের রূপকল্প ধরা পড়েছে এই ধাঁধাটির লৌকিক-আঞ্চলিক বাক্-বিন্যাসে। পুঁটিমাছের ঝক্ছকে রুপোলি অবয়বটি চাঁদের রুপোলি আলোর রূপকল্পে উপস্থাপিত হয়েছে। বিশাল আকাশের সঙ্গে বড় ‘দিঘি’-র সাযুজ্য কল্পনা করা হয়েছে। এটি নিসর্গবিষয়ক একটি উৎকৃষ্ট ধাঁধা।
অপেক্ষাকৃত আধুনিক সময়ে সৃষ্ট একটি মজার ধাঁধা দেখুন :
কালিয়াগঞ্জে একটা আছে, রায়গঞ্জে নাই।
কলিকাতায় দু’টা আছে ভারতবর্ষে নাই ॥
এই ধাঁধাটির উত্তর হচ্ছে ‘ক’।
লোকায়ত বিশ্বাস ও অনুষ্ঠানকেন্দ্রিক একটি ধাঁধা :
বছরে আসে মাসে যায়
দিনে শুকায় রাইতে খায়
এই ধাঁধাটির উত্তর : ‘রোজা’
একবাক্যময় একটি ধাঁধা
দিনের ফল রাইতে ঝরে
এর উত্তর : হাট’।
আর একটি প্রবাদে বিশেষভাবে ধরা পড়েছে কৃষিকর্ম-বিষয়ক অভিজ্ঞতার কথা, জীবনের রীতিনীতির কথা :
যে বান্ধে আগে আল
সেই খায় সোল বুয়াল
যে করে হামের কাম
সেই খায় বাটার পান।
লোকায়ত সমাজে চালাক বা ধূর্ত মানুষের অভাব নেই। সংসারে এরা কম হলেও এদের স্বভাব-চরিত্র বিষয়ে মানুষ নানান রকমের উক্তি-নিরুক্তি করে থাকে–
হাল মাংনা ফাল মাংনা
বিছন পরে পরে
গোরু দুইটা মামু বাড়িকার
পেনাঠিখান র্মহে।
হাল ও ফাল পরের কাছ থেকে চেয়ে নেওয়া। ধানের বিছনটুকুও পরনির্ভর, এমনকি গরু দুটোও মামার বাড়ির। শুধু হালের বলদ তাড়াবার লাঠিটুকুই তার নিজের। লোকচরিত্র বিশ্লেষণের একটা চমৎকার সরস উদাহরণ।
এরকম আর একটি প্রবাদ–
ঘরত্ নাই ভাত ধাপত্ চুলা
বাহিরৎ বেড়াছে কুচি ঝুলা।
ঘরে ভাত নেই, কিন্তু বারান্দায় উনান। বাড়ির বাইরে বেড়াতে যায় ধুতির কোঁচা ঝুলিয়ে। ভন্ড-সাধু-সন্ন্যাসীদের নিয়ে লৌকিক উক্তি :
মন তুই রঙ্গাইস্নি রঙ্গালিস কাপ্ড়া
দাড়ি চুল বাড়ায়ে সাজিয়াছিস বক্ড়া ॥
আÍনির্ভরতা এবং আÍমর্যদার উদাহরণ :
জগায় খাই
তে র্কাহ দুয়ারত্ নি যাই ॥
রীতিমতো মেহনত ক’রে, সঞ্চয় করে জমিয়ে যে ব্যক্তি পরিমিত আহার করে, সে কখনও কারো দরজায় সাহায্যের জন্য হাত পাতে না।
খাদ্য ছাড়া মানুষ বাঁচে না। বাঁচতে পারে না। যে শিশুটির পেটে খাবার নেই, তাকে শুধু আশীর্বাদ জানিয়ে কী লাভ ? আশীর্বাদ তো বাহ্যিক শুভকামনামাত্র। এই বাস্তবিক উপলব্ধিটি ধরা প’ড়েছে একটি প্রবাদে :
‘ভোকের ছোয়া ফের আশোরবাদে বাঁচে’।
(ভোক-খিদে, ছোয়া-শিশু, আশোরবাদ-আশীর্বাদ)
এখানে দারিদ্র্য-পীড়িত লোকমানসিকতার জ্বালা-যন্ত্রণা ধরা পড়েছে, সঙ্গে সঙ্গে বাহ্যিক সহানুভূতি প্রদর্শনের প্রতি ক্ষোভ অভিব্যক্ত হয়েছে। টাকা-কড়ি বিষয়ে সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতা :
টাকায় করে কাম
মিছায় মর্দের নাম
কছাৎ কড়ি হয়
হাটিবার বল হয়।
(কছাৎ–কোঁচড়ে, বল-শক্তি, সাহায্য)
এক টাকায় গরিব সুখী।
হাজার টাকায় শুঁড়ি দুখী ॥
জাতি-ধর্ম-সম্প্রদায়গত ঐক্য-অনৈক্য এবং সামাজিক মান-সম্মান ও অবস্থানের সুস্পষ্ট সম্পর্ক তৈরী করে অর্থনৈতিক মান। এখানে, মর্মান্তিক একটি অভিজ্ঞতা উৎসারিত হয়েছে ছোট্ট একটি প্রবাদে :
যার ঘরত্ নি ভাত।
তার কিসের জাত ॥
মৃত্তিকাচারী জীবনচর্যার গভীর থেকে উচ্চারিত জীবনসত্য :
মিছা কথা ছেচা পানি
জীবন নিয়া টানাটানি ॥
লৌকিক এই অভিব্যক্তিগুলি উত্তর দিনাজপুরের লোকসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। একটি বিয়ের গানে দেখা যাচ্ছে বর পণ হিসেবে নিতে চায় সাইকেল। সাইকেলটি যে কোন জায়গা থেকে কিনলে চলবে না, কিনতে হবে রায়গঞ্জ থেকে। বড় বলেছে : ‘সাইকেল নিব আমি পসিন করে’ মানে আমি নিজে পছন্দসই সাইকেল নেব।
আর একটি গানে দেখা যাচ্ছে :
কন্যার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাবা জোর করে বিয়ে দিচ্ছেন। বিয়েতে কন্যার কোন সায় নেই। সামান্য একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে এক জেলে যুবক সুরজমনি সম্পর্কে সুরজমণির বাবার কাছে নালিশ করে। বাবা রেগে যান। বাবার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করেও লাভ হয় না। শাস্তিদান ক’রে, সুরজমণির বাবা, তক্ষুনি পাল্কী-বেহারা ডেকে, সাজিয়ে গুছিয়ে জেলে যুবকটির সঙ্গে পাঠিয়ে দেন। পাল্কীতে ওঠার আগে সুরজমণি লুকিয়ে ছুরি নেয়। পাল্কীতে সে ছিল একা সে নিঃশব্দে নিজের বুকে ছুরি বসিয়ে দেয়। গন্তব্যস্থলে পৌঁছালে পাল্কীর আগল খুলে দেখা যায়, সুরজমণি মারা গেছে। কাহিনীমূলক এই বিয়ের গানটি করুণ এবং মর্মস্পর্শী
আর একটি বিয়ের গানে ‘রায়গঞ্জ’ এবং ‘দিনাজপুর’ এি দুই স্থাননাম পাওয়া যাচ্ছে। বলা হয়েছে : ‘রায়গঞ্জের সরু সুতা গে মায়ো দিনাজপুরের তাঁতি’। স্থাননাম ও বস্ত্রবয়ন প্রসঙ্গটি এই গানে ধরা পড়েছে। প্রাচীন পৌন্ড্রবর্ধনে, এই দিনাজপুর-রায়গঞ্জ এলাকার নিপুণ বস্ত্রবয়নের কথা বাংলার ইতিহাসে বিধৃত আছে।
নিজের বিয়ের জন্য বিশেষ আর্জি প্রকাশ পেয়েছে একটি গানে :
আর কতদিন রহিমু দাদা গে বয়স খুটির
দাদা গে খালো মালভোগ কলার ছড়ি
মায়ে কহে ছট্ ছট, গে দাদা
টলার লোক কহে বুড়ি
আর কতয় দিন রহিমু দাদা গে
বয়স খুটির...
রায়গঞ্জের সরু সুতো ভাটোল হাটের তাঁতী–
সরু সুতার শাড়ি পিনিহে গে দাদা
যৌবন হল মোর ভাটি
দাদা গে মোক বেহায় দে, কি দে ...॥
মানে হচ্ছে, বয়স বাড়ছে, বয়স লুকিয়ে আর কতদিন চলবে। এবার আমার বিয়ের ব্যবস্থা করো। দাদা, তুমি ভালোই আছো, তুমি মর্তমান কলা খাচ্ছো, ভালোমন্দ খাচ্ছোÑ তোমার চিন্তা কী ? পাড়ার লোকে বলে, মেয়েটা বুড়ি হয়ে গেল, মা বলে ছোট, ছোট। সরু সুতার শাড়ি পড়ে পড়ে আমার যৌবন চলে গেল। এবার বিয়ের ব্যবস্থা করো, ইত্যাদি। লৌকিক ছড়া-ধাঁধা-প্রবাদ-গীতে এরকম অনেক উপাদান উপকরণে এলাকার আর্থ-সামাজিক পটভূমির পরিচয় পাওয়া যায়। কৃষিকর্ম-বিশ্বাস-সংস্কার-লোকচরিত্র-শরীর স্বাস্থ্য-জাতি-জনগোষ্ঠী আÍীয়পরিজন-নীতি-উপদেশ-লৌকিকদর্শন ইত্যাদি বিষয়ের দৃষ্টান্ত কম নয়। এখানে সামান্য কিছু দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা হ’ল। এরকম দৃস্টান্ত পাওয়া যাবে লোককথায় ‘রাড়ির ব্যাটা হিয়ালু’, ‘বাঘ-শিয়াল-রাখাল’, ‘হাতিমারা বীর’ প্রভৃতি লোককথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। আর্থ-সামাজিক অবস্থার বিশেষ পরিচয় পাওয়া যাবে রায়গঞ্জ এবং পার্শ্ববর্তী এলাকার লোকনাট্যে। খনগানের পালায় এই দৃষ্টান্ত প্রচুর। কালিয়াগঞ্জ-হেমতাবাদ-ইটাহার থানা সহ করণদিঘি-চাকুলিয়া-ইসলামপুর থানার গুরুত্ব কম নয়। ইসলামপুর থানার সর্দারভিটা-জগতাগাঁও, মাটিকুন্ডা-২ এলাকায় খনপাঁচালী ‘সর্বহারা’ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এই পালার রচনাকার টিকমলাল সিংহের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ‘বন্দনা’ পর্বের এই গানটি শোনা যায় :
সরকার দিচ্ছে পঞ্চাতর নির্বাচন
পাবলিকলার উঠিল্ কলবন
মায়া র্মদে মেম্বারিত্ দাঁড়াচ্ছে
বড়লোকলার উঠে গেল্ সম্মান।...
সাক্ষাৎকার নেওয়া হয় ১৯৯৪ সালের নভেম্বর মাসে। আশেপাশের গ্রামে আরও কিছু পালার কথা জানা যায়। যেমন বৌদির চক্রান্ত, সতী হেব্লা, ভাইভাই মমতা, দুরাচার জমিদার, মুক্তিমালা, ন্যায়-অন্যায় প্রভৃতি। কাচারীগছ হাটের চোরচুন্নি-নটুয়া গানের কথাও এখানে উল্লেখ করা যায়।
ঐতিহাসিক-ভৌগোলিক-পরিবেশ-পরিস্থিতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর নিবিড় সংযোগ থাকে। একটি এলকার সংহত জীবনচর্যার ভেতর থেকে নির্দিষ্টভাবে একটা সাংস্কৃতিক অভিমুখীনতা বিন্যস্ত হতে থাকে (Specific Cultural Setting)। এই অভিমুখীনতার প্রক্রিয়া থাকে অবশ্যই। যে প্রক্রিয়ার মূল কথা হল ‘Constant Collaboration between the individual and the group’। এই Constant Collaboration কারণ, উপলব্ধির অন্তর্প্রবাহে সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সংবেদন থাকে। যে সংবেদনশীলতা লোকসাহিত্যের প্রাণধর্ম উপহার দেয় সজীবতা। খনগানের ‘আমাবস্যা-পুন্নিমা’, ‘মিনতিশরী,’ ‘মায়াবন্ধকী’ থেকে শুরু করে‘গজুয়া ভাতার চেয়ারম্যান বউ’ মায়াপাচার দালাল মার্ডার’ প্রভৃতি পালায় সমাজ-সংঘাতের প্রচুর নিদর্শন পাওয়া যাবে। ট্রাডিশনাল বাক্নির্ভর অন্যান্য শাখার মতো লোক-পালাগুলিতে এই সজীবতা পাওযা যাবে। একথা মনে করার কোন কারণ নেই যে এই স্বতোৎসার সৃজনপ্রক্রিয়া এখনকার গ্রামে অবলুপ্ত হয়ে গেছে। লোকায়াত সমাজ আজও সৃষ্টিশীল, গ্রামীণ মানুষ তথা কথিত অনড়, অচল নন। নারীসমাজও যথারীতি সৃষ্টিকর্মে আছেন। সমাজের অন্তর্গত অবস্থানের পরিবর্তন যেমন ঘটছে, তেমনি এই সব সৃজনকর্মেও পরিবর্তন ঘটছে। তার নিদর্শন বাক্কেন্দ্রিক সংস্কৃতির নানা শাখায় ছড়িয়ে আছে।
শেষকথা :
সার্বিক সাংস্কৃতিক এই দুঃসময়ে, বিশেষ করে দ্রুত পরিবর্তনশীল এই মুহূর্তে, লোকায়ত কিছু প্রকরণে বহিরঙ্গ-অন্তরঙ্গ কিছু পরিবর্তন ( ঈঁষঃঁৎধষ ঈযধহমব) ঘটছে। লোকভাষায় অনিবার্য পরিবর্তন ঘটছে, যার ছবি পাওয়া যাচ্ছে নতুন পালাগুলিতে। রায়গঞ্জের ‘বন্ধুয়ালা’ দলের সাম্প্রতিক খনগানের সংলাপে এই নতুনত্ব লক্ষ করবার মত। এই দৃষ্টিকোণে উত্তর দিনাজপুরের লোকসাহিত্যের আর্থসামাজিক পটভূমির অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণে আমরা আরও এগিয়ে যেতে পারব।
ভাওয়াইয়া উৎসব স্মারক গ্রন্থ : ২০০৬, ইসলামপুর, উত্তর দিনাজপুর।