কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ গানের মাধ্যমে তাঁর বাণীকে
বোঝাতে চেয়েছেন। স্বদেশপ্রীতিমূলক একটি সঙ্গীত এখানে উল্লেখযোগ্য —
‘ও আমার দেশের মাটি, তোমার ’পরে ঠেকাই মাথা,
তোমাতে বিশ্বময়ীর তোমাতে বিশ্বমায়ের আঁচল
পাতা।’’
দেশ বা ‘স্বদেশ’ বলতে রবীন্দ্রনাথ শুধু
নিজের জন্মভূমি নয়, গোটা বিশ্বজগৎকেই বুঝিয়েছেন। আর দেশ মানে তো শুধু মাটি নয়,
আপামর জনসাধারণই দেশের প্রাণ। স্বদেশ-ভাবনায় রবীন্দ্রনাথ উদার দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয়
দিয়েছেন।
রবীন্দ্রনাথের শৈশবকালে ঠাকুরবাড়ির সাহায্যে
‘হিন্দু মেলার (১৮৬৭) সৃষ্টি হয়। তাঁর মনোজীবনে নানা দিক থেকে এই মেলার গুরুত্ব
অপরিসীম। তখন রবীন্দ্রনাথের বয়স পাঁচ বৎসর কয়েকমাস মাত্র। শিক্ষা,দীক্ষা, কৃষি, সাহিত্য — প্রভৃতি বিচিত্র দিকে
জাতির সামগ্রিক একটি পূর্ণ স্বাদেশিকতাবোধ
জাগ্রত করাই ছিল এই মেলার মুখ্য উদ্দেশ্য।
এই মেলায় রবীন্দ্রনাথ ‘হিন্দু মেলার উপহার’
নামে এক জাতীয় ভাবোদ্দীপক কবিতা পাঠ করেন। রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন চৌদ্দ বৎসর নয়
মাস মাত্র। কবির দেশপ্রীতি ও স্বাজাত্যবোধ কত প্রবল ছিল তার নিদর্শন মেলে চারিত্রিক
অন্তঃসারশূন্য ইঙ্গবঙ্গীয়দের কাহিনি বর্ণনার মাধ্যমে। ‘য়ুরোপ প্রবাসী’র পঞ্চম পত্রে ইঙ্গবঙ্গীয়দের
নৈতিক অধঃপতনের বিস্তৃত বর্ণনা রয়েছে। আবার কবি স্পষ্টভাবে স্বীকার করেছেন য়ুরোপীয়দেয়
কাছ থেকে আত্মনির্ভরশীলতা, স্বাধীনতাপ্রিয়তা ও পৌরুষ শক্তি প্রভৃতি গুনাবলী শিক্ষা করতে
হবে।
য়ুরোপীয় সমাজের স্ত্রী-পুরুষের ব্যক্তিস্বাধীনতা
আমাদের দেশে প্রচলনের পক্ষপাতী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। স্ত্রী-পুরুষে একত্র মিলে কাজকর্ম,
আলোচনা ও আনন্দ করা অসামাজিক বা অশোভনীয় নয়। এই মনোভাব প্রকাশের জন্য ‘ভারতী’র সম্পাদক দ্বিজেন্দ্রনাথ
ঠাকুরের সঙ্গে কবির বাগ্বিতন্ডা উপস্থিত হয়।
ভারতীয় সমাজে নারীর স্বাধীন সামাজিক অধিকার
স্বীকৃত ছিল না। বিলাতে গিয়ে দেখলেন নারীরা আপন ভাগ্য জয় করার অধিকার পেয়েছে। নারী-পুরুষের
সমানাধিকার লাভ ও কর্ম প্রচেষ্টায় দেশের অভ্যুদয় ঘটে। কবি উপলব্ধি করেছিলেন —
‘মেয়েদের সমাজ থেকে নির্বাসিত করে দিয়ে আমরা কতটা সুখ ও উন্নতি থেকে বঞ্চিত হই তা
বিলেতের সমাজে এলে বোঝা যায়।’
‘ভারতীর সম্পাদকের বক্তব্য ছিল — স্ত্রীদের অবাধ স্বাধীনতা
দিলে তাঁরা উচ্ছৃঙ্খল হয়ে যাবে — তখন বিনয়, ভক্তিমত্তা, সারল্য প্রভৃতি গুণাবলী তাঁদের অন্তর থেকে তিরোহিত হবে। রবীন্দ্রনাথ
বললেন — স্বীধানতা অর্থে উগ্র ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য নয় — মানবচিত্তের বিস্তৃতি
ও বিকাশ। সারল্য, শোভনতা, বিনয়, ভক্তিমত্তা প্রভৃতি গুণাবলী প্রকৃত ব্যক্তি স্বধাীনতার আদর্শ।
দেশের উন্নতি সাধনের জন্য জীবনের সঙ্গে সম্পর্ক
রহিত কোনপ্রকার রাজনৈতিক আন্দোলন ও উত্তেজনাপূর্ণ কর্মপন্থাকে রবীন্দ্রনাথ স্বীকার
করেননি। মানুষের সামগ্রিক জীবনের পরিপূর্ণ বিকাশই তাঁর দেশপ্রেমের মূল লক্ষ্য। সাহিত্যে
দেশেপ্রেমের উত্তেজনা আতিশয্যকে তিনি বরদাস্ত করতে পারেন নি তা আমরা ‘ভুবন মোহিনী’
প্রবন্ধে পাই। দেশের সর্বাঙ্গীন কল্যাণের জন্য প্রথমেই প্রয়োজন দেশেবাসীর সুপ্তচিত্তের
উদ্বোদন। তাই রবীন্দ্রনাথ আন্দোলনগুলি ভালোচক্ষে দেখতে পারেন নি —
‘দেশহিতৈষিতা আলো জ্বালিবার গ্যাসের মতো যতক্ষণ
গুপ্তভাবে চোঙের মধ্য দিয়া সঞ্চারিত হইতে থাকে, ততক্ষণ তাহা বিস্তর
কাছে লাগে — কিন্তু যখন চোঙ ফুটা হইয়া ছাড়া পায় ও বাহির হইতে থাকে,
তখন দেশছাড়া হইতে হয়।’
কবি গ্রামসেবার আদর্শকে গুরুত্ব দিলেন। ‘ফিরে চল মাটির টানে’—
শিক্ষিতদের মাটির ঘরে ঘরে গিয়ে প্রীতির স্পর্শে আত্মমর্যাদার দীক্ষায় দেশের মানুষকে
জাগাতে হবে। মৃতকল্প পল্লী বুকে প্রাণের স্ফূরণেই দেশের জন্মান্তর ও রূপান্ত ঘটবে।
জনসাধারণের উন্নতি ব্যতিরেকে দেশের যে উন্নতি তা খন্ড ও অসম্পূর্ণ। সমকালীন ভারতের
অবস্থার দিকে তাকিয়ে কবি বললেন — ইউরোপীয় আদর্শে দলবদ্ধ হয়ে কাজ করবার প্রবল নেশা আমাদের পেয়ে
বসেছে। সম্মিলিত কর্মপ্রচেষ্টায় যে বিরাট সাফল্য অর্জন করা যায় — এ সম্পর্কে কবি একমত।
তিনি ঔপনিষদিক কর্মানন্দে জীবন বিকাশের চরিতার্থতায় নিমগ্ন থাকতে বলেছেন —
‘হওয়াটা জগতের চরম আদর্শ, করাটা নহে।’
ভারতবর্ষের অবনতির কারণ — আমাদের কর্মশক্তির
দৌর্বল্য ও সকল বিষয়ে বিলাতী অনুকরণপ্রিয়তা। কবির মতে — কর্মে, শিল্পে, সাহিত্যে ,
লোকসংস্কৃতিতে ও স্বদেশী জিনিসপত্রে স্বদেশকে
পূর্ণভাবে উপলব্ধি করতে হবে। য়ুরোপীয় সভ্যতা যে নিকৃষ্ট তা নয়, য়ুরোপীয় সভ্যতার শ্রেষ্ঠ
সম্পদকে দেশীয় জিনিস করে নিতে হবে — ‘একথা আমরা বলি না যে বিদেশী সামগ্রী আমরা
গ্রহণ করিব না। গ্রহণ করিতেই হইবে কিন্তু স্বদেশীয় আধারে গ্রহণ করিব।’
স্বদেশী আন্দোলন থেকে সরে আসার পর থেকেই মূলতঃ
রবীন্দ্রচিন্তা থেকে হিন্দু জাতীয়তা-বোধের সংকীর্ণতা ছিন্নমূল হতে থাকে এবং বিশ্বমানবিকতার
আদর্শ স্থান পায়। ‘তপোবন’ প্রবন্ধে পাই — ‘যে সত্যে ভারতবর্ষ আপনাকে আপনি নিশ্চিতভাবে
লাভ করতে পারে সে সত্যটি কী ? সে সত্য প্রধানতঃ বণিকবৃত্তি নয়, স্বরাজ্য নয়,
স্বাদেশিকতা নয়, সে সত্য বিশ্বজাগতিকতা। .... ভারতবর্ষের অন্তরের মধ্যে যে উদার
তাপস্যা গভীরভাবে সঞ্চিত্ হয়ে রয়েছে সেই তপস্যা আজ হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ এবং ইংরেজকে
আপনার মধ্যে এক করে নেবে বলে প্রতীক্ষা করছে — দাসভাবে নয়,
জড়ভাবে নয়, সাত্ত্বিকভাবে — সাধকভাবে।’
‘বিশ্ববোধ’ প্রবন্ধে কবি বলেছেন
যে দেশকে উগ্র জাতীয়তাবাদের আদর্শ পরিত্যাগ করে আন্তর্জতিকতার আদর্শ গ্রহণ করতে হবে।
ধর্মের বিকৃতি ও অন্ধ আচার — অনুশাসন পদ্ধতি আমাদের সমাজ জীবনকে দীর্ঘকাল ধরে সংকীর্ণ,
খন্ড ও অচল, অনড় করে রেখেছিল। ধর্মের বিকৃতি দূর করে সমাজকে মুক্ত ও গতিশীল
করার জন্য বারে বারে বলিষ্ঠ জীবনচেতনার বাণী রবীন্দ্রকন্ঠে ধ্বনিত। এ ব্যাপারে সর্বাগ্রে
প্রয়োজন আপামর জনসাধারণের সঙ্গে শিক্ষিত সম্প্রদায়ের হৃদয়ের যোগ ও প্রীতির প্রসার।
রবীন্দ্রনাথ পৃথিবীকে সুন্দর করে গড়ে তুলতে
চান, সমাজকে ন্যায়ের ভিত্তিতে সর্বলোকের কল্যাণের জন্য প্রতিষ্ঠিত করতে চান বলেই কল্পনার
ভাবলোক সৃষ্টি করেন সাহিত্যে। সেখানে তাঁর লক্ষ্য —
‘সুখ হাসি আরো হবে উজ্জ্বল
সুন্দর হবে ধরনীর তল।
স্নেহসুধামাখা বাস
গৃহতল
আরো আপনার হবে।
রবীন্দ্রনাথের স্বদেশভাবনা দেশ ও কালের পরিপ্রেক্ষিতে
তাঁর কবিতা, উপন্যাস, গল্প, নাটক ও সংগীতাদিতে পরিণত রূপ নিয়েছে। ‘চিত্রা’ কাব্যের এবার ফিরাও মোরে’ কবিতায় কবি গভীরভাবে
বস্তুনিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন —
‘এবার ফিরাও মোরে,
লয়ে যাও সংসারের তীরে,
হে কল্পনে,
রঙ্গময়ী।’
দরিদ্র, অসহায় মানুষের জন্য
প্রয়োজন শিক্ষাব্যবস্থা ও নৈতিক চরিত্র গঠনের ব্যবস্থা। দেশকর্মীদের উদ্দেশ্যে কবি বললেন —
‘এই সব মূঢ় ম্লান মূক
মুখে
দিতে হবে ভাষা,
এই সব শ্রান্ত, শুষ্ক ভগ্ন বুকে
ধ্বনিয়া তুলিতে হবে
আশা।’
দেশের জন্য ত্যাগ ও কর্মপ্রচেষ্টা প্রয়োজন।
কবি রাজনৈতিক নেতাদের লক্ষ্য করে বললেন — ‘যারা শুধু মরে কিন্তু
নাহি দেয় প্রাণ
কেহ কভু তাহাদের করেনি
সম্মান।’ (চৈতালী/অভিমান)
দেশের জনবল হচ্ছে দেশহিতের বড় শক্তি। দেশনেতা
জীবিত থাক বা না থাক তার আদর্শে অনুপ্রাণিত
হয়ে কাজ করতে হবে। জনগণ প্রত্যেকেই নিজের অধিকারের মধ্যে রাজা ‘আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে।’
রাজা সবাইকে মান মর্যাদা দেন বলেন নিজে সে মর্যাদা ফিরে পান। সার্বিক গণচেতনা জাগাবার
উদ্দেশ্যে কবি বলেছেন— ‘কে লইবে মোর কার্য
কহে সন্ধ্যা রবি
শুনিয়া জগৎ রহে নিরুত্তর
ছবি।
মাটির প্রদীপ ছিল সে
কহিল স্বামী
আমার যেটুকু সাধ্য
করিব তা আমি।’ (কণিকা/কর্তব্যগ্রহণ)
‘গোরা’ (১৯১৬) উপন্যাসে কবি
বিশ্বমানবতার আদর্শে স্বাদেশিকতাকে সমৃদ্ধ করে তুললেন। এই আদর্শ ভারতবর্ষের সভ্যতার
প্রাণধর্ম। যুগে যুগে কাব্যে, সাহিত্যে, দর্শনে এর বিচিত্র
সুর ধ্বনিত হয়েছে। গোরার জননী আনন্দময়ী, ভারতাত্মার জীবন্ত প্রতীক — ‘চিরকল্যাণময়ী তুমি
ধন্য্।’ অজ্ঞাত কুলশীল জারজ সন্তানকে যে বুকে টেনে নেয় — তার একটিমাত্র পরিচয়
মা, শুধু চিন্তা ভাবনায় নয়, জীবনের মধ্যেও তার পরিচয় মিলবে ভারতে। আনন্দময়ী তারই জাজ্বল্যমান
প্রমাণ — ‘আপনি আচরি ধর্ম অপরে শিখায়।’
‘গীতাঞ্জলি’র একটি গানে এই উপলব্ধি
আরো প্রগাঢ়তর হয়েছে। অতীতে আর্য অনার্য শক, হূন, পাঠান, মোগল মিলে ভারতে এক
মহাজাতীয় ঐক্য গড়ে উঠেছিল— ‘বিভেদ ভুলিয়া জাগায়ে তুলিল একটি বিরাট হিয়া।’ কবি সকলকে সাদর আমন্ত্রণ
জানিয়েছেন ভারতে সর্বমানবিক প্রীতির বন্ধনে মহাজাতীয়তা প্রতিষ্ঠার জন্য —
‘এসো হে আর্য এসো অনার্য,
হিন্দু মুসলমান
এসো এসো আজ তুমি ইংরাজ,
এসো এসো খৃষ্টান।
... ... ... ... ...
সবার পরশে পবিত্র করা
তীর্থ নীরে
আজি এ ভারতের মহামানবের
সাগর তীরে।’
পঙ্গু জীবনযাত্রার সংকীর্ণ গহ্বর থেকে বিরাট
জীবনের বৃহত্তর কর্মক্ষেত্রে অগ্রসর হওয়ার জন্য বাঙালীদের উদ্দেশ্য করে বলেছেন —
‘পুণ্যে পাপে দুঃখে
সুখে পতনে উত্থানে
মানুষ হইতে দাও তোমার
সন্তানে।
সাত কোটি সন্তানের
হে মুগ্ধ জননী
রেখেছো বাঙালী করে
মানুষ করনি।’
পোষাক পরিচ্ছদ, ভাষা, আচার-আচরণের মধ্যে
বাহ্যিক বাঙালীত্বে বাঙালীর প্রকৃত পরিচয় নয়। মানুষের পরিচয় মনুষ্যত্ব অর্জনে ও মনুষ্যত্বের
পূর্ণতা সাধনে। এতে বৃহত্তর জীবন পরিধির মধ্যে মানুষের ব্যাপ্তি ঘটে। বৃহত্তর জীবনের
সঙ্গে সংযোগ সাধনেই জীবনের পূর্ণতা প্রাপ্তি ঘটে।
রোগে, শোকে, অভাবে, অনটনে, অশিক্ষায় অভিজাতদের
ঘৃণার অত্যাচারে দেশের বৃহৎ জনসম্প্রদায়ের শক্তির অপচয় ঘটছে দেখে কবির বেদনার অন্ত
ছিল না। তাই প্রথম থেকেই কবি শিক্ষিতজনকে ঘৃণার ভাব বর্জন করে যথার্থ প্রীতি ও আন্তরিকতা
নিয়ে এগিয়ে আসবে। নতুবা —
‘যারে তুমি নীচে ফেল
সে তোমারে রাখিবে যে নীচে।
পশ্চাতে রাখিছ যারে সে তোমার পশ্চাতে টানিছে।
উপরের আলোচনার নিরিখে একথা বলা যায় যে রবীন্দ্রনাথের
উদার ও মহৎ চিত্তে বিশ্বমানবতাবোধ জাগরূক ছিল। তাই তাঁর নিকট শুধু দেশবাসী নয়,
গোটা বিশ্ববাসীর প্রতি ছিল অকৃত্রিম ভালোবাসা ও অপরিসীম দরদভরা প্রাণের আকুতি।
তাই স্বদেশ, বিদেশ, আপন-পরের সংকীর্ণ গন্ডী অতিক্রম করে গোটা বিশ্বজগতকেই আপন ভেবে
তাঁর নিজের ঘর খুঁজে বেড়িয়েছেন —
‘সব ঠাঁই মোর ঘর আছে
/আমি সেই ঘর মরি খুঁজিয়া।’
আর এখানেই তাঁর স্বদেশভাবনার মূল সুরটি আমরা
খুঁজে পাই।
––––––––––––––––––––––––––––
কালিনী, জানুয়ারী ২০১০
No comments:
Post a Comment