গোটা কয়েক সিদ্ধ
আলু চটকে অল্প নুন আর পুরোনো ঔষধের ছোট্ট শিশিতে রাখা একফোঁটা সরষে তেল ঢেলে দিল
লিলি। কিছুক্ষণ আলুগুলো চট্কালো, তারপর গোল গোল নাড়কেল নাড়ুর মত করে শিবুর পান্তাভাতে
দিল।
— একটা কাঁচা
লঙ্কা নাই রে ?
— না !
— দ্যাখ না খুঁজে
...
— বললাম তো নাই
! লিলি বিরক্ত হয়ে কোমরে শাড়ীর আঁচল লেপ্টে
নিল।
শিবু পান্তাভাতে
আলুসেদ্ধ মেখে গোগ্রাসে গিলতে থাকে। তার ভীষণ ক্ষিদে পায়। হাঁড়িতে যতটুকু পান্তাভাত
ছিল, সবটাই লিলি শিবুর থালায় দিয়েছে।
একটা কাঁচা লঙ্কা
হলে শিবু তৃপ্তি করে খেতে পারতো। অনেক দিন হলো পিঁয়াজের নামগন্ধ নেই বাড়িতে। কুড়ি টাকা
কিলো পিঁয়াজ কিনে খাওয়া শিবুর পক্ষে বিলাসিতার সমান।
অর্দ্ধেক পান্তাভাত
আর অল্প আলুসেদ্ধ লিলির জন্য রেখে ঢক্ঢক্ করে তিন গেলাস জল খেয়ে শিবু একটা মস্ত ঢেকুর
তোলে।
— ওটা রাখলে কেন
?
— তোর জন্য
...
— খেয়ে নাও। পুরুষ
মানুষের পেট না ভরলে খাটবে ক্যামনে ? লিলি শিবুর এঁটো হাত ধরে বসায়।
শিবু এক পলক তার বৌয়ের দিকে তাকায়। চোখে এক অসহায় চাউনি। শিবু
জানে, লিলি মাঝে মাঝে উপোস করে থাকে। কেননা ভাত প্রায় দিন বাড়ন্ত।
— তাহলে তুইও
খেতে বস। একরকম জোর করে লিলিকে পাতে বসাল সে।
— তুমি আগে খাও
...
— আরে বাপু পেটে
জায়গা থাকলে তো ? শিবু এই বলে নিজের পেটটা যথাসম্ভব ফুলিয়ে দেখায় লিলিকে। তারপর জলের
ঘটি নিয়ে সোজা মুখ ধুতে চলে যায়।
লিলি তার স্বামীর
যাওয়ার পথে তাকায়, সেই তাকানোর মধ্যে ছিল এক
সুখী দম্পতির প্রচ্ছন্ন দৃষ্টি। তারপর মাথা নীচু করে শিবুর এঁটো পাতে খেতে বসে যায়।
এইভাবে শিবুর
সংসারের চাকা এগিয়ে চলে। অভাব আছে, কোন অভিযোগ নেই। কিন্তু এভাবে আর কতদিন চলবে ? মাদুরে
শুয়ে শিবু আকাশ পাতাল ভাবে, ভাবতে থাকে। লিলিকে নিয়ে সংসার পাতা তিন বছর হল। নিজের
রোজগারের কোন ঠিক ঠিকানা নেই। ছেলে একটা হয়েছিল তার, আঁতুরেই মারা যায়। ভালই হয়েছে,
শিবু ভাবে। নইলে তাকে কি খাওয়াতো সে ? তার বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে যায় অজান্তে।
শিবু একমনে তার
বৌয়ের খাবার দেখে। লিলি চালের কাঁকড় বাছার মত ধীরেসুস্থে খাচ্ছে। শিবু জানে, পাতে সে
যা পান্তা রেখে উঠেছিল, তা নামমাত্র। ইচ্ছা করেই সে পাত থেকে উঠেছে। লিলির জন্য তার
ভীষণ কষ্ট হয়! কিন্তু তার কষ্ট লাঘব করার কোন কৌশল শিবুর জানা নেই। লিলি খেতে খেতে
চোরা চাউনি মেলে একবার স্বামীর দিকে তাকায়, তারপর খাওয়া শেষে এঁটো থালা বাসন নিয়ে চলে
যায় কলতলায়।
চুপসে যাওয়া সাইকেল
রিকশার দুটি চাকা সমেত একচিলতে উঠোনে শিবুর ঠেলা পড়ে ঘুমাচ্ছে আজ তিনদিন ধরে। টায়ার
দুটি এতই জীর্ণ যে ভরপেট হাওয়া গিলে রাখতে পারে না, ফলে শিবু তার ঠেলায় বেশী মাল চাপাতে
পারে না। এছাড়া রাস্তার যা অবস্থা।
একটি রাষ্ট্রায়ত্ত
ব্যাঙ্কের কাছে লোন নিয়ে ঠেলাটা কিনেছিল সে। প্রথম প্রথম রোজগার ভালই হতো তারপর ধীরে
ধীরে কমে গেল। কারণ টায়ার টিউব বেশ কয়েকবার মেরামত আর পাল্টাতে গিয়ে রোজগারের যেটুকু
বাঁচত তার সিংহভাগ চলে যেত ব্যাঙ্কের কিস্তি শোধ দিতে। তার উপর দুজনের পেট ভরার মতো
চাল-ডাল নুনের খরচ !
তবুও কোনমতে সংসারটা
চালিয়ে নিয়ে গেছে লিলি। কিন্তু এমাসে হঠাৎ অকাল বৃষ্টি, ভারতবন্ধ, বাংলাবন্ধ আর খুনখারাপির
হরতালের জন্য শিবুর রোজগার অনেক কমে গেছে।
আগামী মাসে শিবুকে
ব্যাঙ্কের শেষ কিস্তি দিতে হবে। কিন্তু কেমন করে দেবে সে ? যদি কোন মতে দেওয়া যায় তাহলে
ঠেলাটা সম্পূর্ণ তার হয়ে যাবে... একথা ভাবতে গিয়েই শিবু মাদুরের উপর সোজা হয়ে বসল। ঠেলাটার কাছে গিয়ে গভীর মমতায় কাঠের ফ্রেমে
হাত বোলাল। বাঁহাতে একটা চাকা তুলে ডান হাতে সজোরে ঘুরিয়ে দিল। চাকাটা কয়েক পাক খেয়ে থমকে গেল।
— দ্যাখ রে লিলি,
শালা চাকাটাও আর তেমন ঘুরছে না।
— ত্যাল না দিলে
ঘুরবে ক্যামনে ?
— আরে বাবা এ তো আর ‘মিসিন’ না যে রোজ রোজ তেল খাবে,
এযে ছোট ছোট বলের উপর ঘুরছে — বলে চাকাটা আরও একপাক ঘুরিয়ে দিল।
লিলি চুপচাপ তার
স্বামীর চাকা ঘোরানো দেখতে লাগল। সে জানে,
শিবু ঠেলাটাকে ভীষণ ভালবাসে। নতুন ঠেলাটা যেদিন এনেছিল, সেদিন খুশিতে ডগ্মগিয়ে
বলেছিল, ঘরে লক্ষ্মী আনলাম রে বৌ! তোর জন্য
এবার থেকে নতুন নতুন শাড়ি জামা কিনে আনবো।
কিচ্ছু অভাব থাকবে না, জয় ঠেলা মাইকি জয়!
শিবু লিলিকে সেদিন
ঘুমুতে দেয়নি। কত গল্প করেছে আর ঐ সামান্য ঠেলাকে ঘিরে কত না স্বপ্ন দেখেছে। শিবুর
কথা শুনে লিলির মনের মধ্যেও সচ্ছলতার গভীর প্রত্যয় ডাক দিয়েছিল বৈকি!
কিন্তু আজ সে
স্বপ্ন ভেঙে চুরমার। অনাহার আর অভাবে লিলির সংসার আজ বিধ্বস্ত। লিলি শিবুর গা-ঘেঁষে
দাঁড়ায়।
— বুঝলি রে, এ
শালা এখন অসুখে পড়েছে। শিবুর শুকনো মুখে চিন্তার গভীর ছাপ স্পষ্ট।
— নাড়–র দোকানে
একটু মেরামত করে নিলেই হয়। মুখ ফস্কে বলে ফেলে লিলি।
— সে তো অ-নে-ক
টাকার ব্যাপার রে !
— তা হলে কতদিন
বসিয়ে রাখবে ?
শিবু ডান হাতের
এক একটি আঙুল গুণে হিসেব দিল — একটা নতুন টায়ার একশো টাকা, অন্য চাকাটার মেরামতি কুড়ি
টাকা — মোট একশো কুড়ি টাকা। এই টাকা কোথায় পাবো ? হতাশায় শিবু ধপাস্ করে ঠেলায় বসে
পড়ে।
— নাড়– বাকী রাখবে
না ?
— তুই তো নাড়ুকে
চিনিস না, শালা একমদ চশমখোর। সেবার ‘ভল্টু’র এক টাকাই বাকী রাখতে চায়নি তো একশো কুড়ি
টাকা ! নাঃ দেখছি তোর মগজে একটুও ঘিলু নাই।
— তবুও একবার
ঠেলাটা নিয়ে যাও না ওর দোকানে, আমি যদি বলে কয়ে রাজি করাতে পারি।
— তু-ই ! হো-হো
হেসে একপাক ঘুরে নিল শিবু। দমকা হাসিতে লিলির কথাটা সে নস্যাৎ করে দিল।
কিন্তু শিবু রাজী
হলো শেষ পর্যন্ত ঠেলাটাকে নাড়ুর দোকানে নিয়ে যেতে। তবে একটি শর্তে। যদি নাড়ু– তাকে ফিরিয়ে
দেয়, অপমান করে তাহ’লে তার সম্পূর্ণ দায়দায়িত্ব লিলির উপর বর্তাবে। এই বলে শিবু রোজগারের
ধান্ধায় রেল ষ্টেশনে চলে যায়।
লিলি নাড়–কে পাড়া
প্রতিবেশী হিসেবে ভালভাবেই চেনে। কয়েকটা বাড়ির পরই নাড়ুর বাড়ি ও দোকানঘর। একা থাকে।
পাকা রাস্তার ধারে নাড়ুর ‘সাইকেল রিপিয়ারিং শপ্’। কয়েকটা পুরোনো সাইকেল টায়ার দোকানের
সামনে ঝুলিয়ে রেখেছে। ওই টায়ারগুলিই সাইকেল মেরামতি দোকানের অলিখিত সাইনবোর্ড।
লিলি নাড়–র দোকানের
সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। নাড়– তখন রেঞ্জ দিয়ে পুরোনো সাইকেলের চাকা ফিটিং করছিল।
— নাড়– দা।
— ওহ বৌদি, ময়লা
জামায় হাত মুছে তাকাল নাড়ু ।
— আচ্ছা, একটা
রিকসা টায়ারের দাম কত ?
নাড়ু যেন আকাশ
থেকে পড়ল। বললে, কেন ? দাম দিয়ে কি হবে শুনি।
— না, বলছিলাম
কি ... ওর ঠেলার একটা টায়ার নষ্ট হয়ে গেছে তাই।
— ও... নাড়– তাচ্ছিল্যের
ভঙ্গি করে সোজাসুজি লিলির দিকে তাকিয়ে ফোড়ণ কাটল, তা শিবু বুঝি তোমায় পাঠালে ?
— না-না ! লিলি
দু’পা এগিয়ে দোকানে ঢোকে। ব্যস্ত হয়ে বলে, ওকে না জানিয়ে এসেছি ও কোথায় যেন গেছে
— তাহলে ওকেই
আসতে বল বৌদি। শালা মুফতে কত টুকিটাকি কাজ করে নিয়ে যায় যখন তখন। নাড়ু আবার সাইকেল
রেঞ্জ নিয়ে চাকা ফিটিং করতে লেগে যায়।
লিলি একটু সহজ
হলো। দোকানে তখন কেউ নেই। সে নাড়ুর খুব কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়াল। যথাসম্ভব গলা নামিয়ে
মিনতির সুরে বলল — নাড়–দা, ঠেলাটা আজ তিনদিন
ধরে পড়ে আছে। তাই রোজগারপাতি সব বন্ধ। দুজনে নিরম্বু উপোস করছি। তুমি যদি ঠেলাটা মেরামত
করে দাও তাহলে দুজনে কোন মতে খেয়ে পড়ে বাঁচব আর ধীরে ধীরে তোমার দেনা শোধ করে দেব।
এক নিঃস্বাসে কথাগুলি বলে থামল লিলি। সে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে নাড়ুর দিকে। লিলি মনে
মনে ভাবে, এই সেই লোক, যে পারে তার ঘরে অভাব অনটনের সুরাহা করতে। কি করে যে নাড়–র দেনা
শোধ করবে সে নিজেই জানে না। তবুও বাঁচার একটি ক্ষীণ আশা নিয়ে সে এসেছে।
কঠিন সংকল্প নিয়ে
এসেছে লিলি। যে কোন মূল্যে নাড়ুকে রাজী করাতে হবে। ঠেলা চললে রোজগারপাতি সব হবে। তার
কাছে এখন ভালবাসা, সুখী দাম্পত্য, লোকনিন্দা আর সতীত্ব অর্থহীন।
নাড়– দাঁড়িয়ে
লিলির আপাদমস্তক একবার দেখে নিল। সে দেখলো, হাতে শাঁখা আর লোহার চুড়ি ছাড়া কানে একজোড়া
দুল। নিশ্চয়ই সোনার না ইমিটেশনের। তাহলে কি দিয়ে শিবুর বৌ তার ধারদেনা শোধ করবে যদি
সে শিবুর ঠেলায় নতুন টায়ার আর মেরামত করে দেয় ?
নাড়– লিলির দিকে
তাকিয়ে দেখে — লিলিও নিষ্পলক তার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে মিনতি আছড়ে পড়ছে। তার মনে হলো
শিবুর ঘরে যা আছে, তার তাও নেই। লিলির কাছে এগিয়ে যায় নাড়ু। দুজনের চোখের পাতা কয়েক
মুহূর্ত আটকে রইল পরস্পরের চোখে। আর দেনা পাওনার হিসেব তক্ষুনি লেখা হয়ে গেল চোখের
ভাষায়।
কয়েকটি মাস হারিয়ে
গেল।
শিবু লাফাতে লাফাতে
ঘরে ঢোকে। হাতে একটা রুই মাছ। জামার পকেট থেকে কয়েকটা এক, দুই পাঁচ টাকার জীর্ণ নোট
আর কিছু খুচরো পয়সা বের করে লিলির হাতে দিয়ে বলে, বুঝলি রে — মাছটাকে ভাল করে বাঁধবি
আর এই ধর টাকাগুলো। শালা নাড়ুকে দেখিয়ে দেব
শিবু ব্যাটা ধার শোধ করতে জানে। তবে যাই বলিস, ঠেলাটা এখন মোটর গাড়ির মত দৌড়ায়। সত্যি,
তুই আমার লক্ষ্মী বৌ! লিলি চুপ করে থাকে।
লিলি তার স্বামীকে
ভাতে থালা এগিয়ে দেয়। পাতে রুই মাছের মাথা দিয়ে বলে, কাঁচা পিঁয়াজ আর লঙ্কা দিব ?
— নাঃ লাগবে না
!
— তুমি তো ভাতের
সাথে কাঁচা লঙ্কা খেতে ভালবাসতে ?
— লঙ্কার ঝাল
আর ভাল লাগে না রে।
শিবু লিলিকে কাছে
বসায়। রুই মাছের মাথা থেকে একটু ভেঙে তার মুখে গুঁজে দেয়। লিলির মাছের গন্ধ সহ্য হয়
না। ওয়াক্ — বমি করে ফেলে দেয়।
বমি দেখে শিবু
ঘৃণায় পাত থেকে উঠে দাঁড়াল। এঁটো হাতে একটা প্রচ- থাপ্পর লিলির গালে বসিয়ে দিয়ে চিৎকার
করে ওঠে, দিলি তো সব নষ্ট করে। সারা দিনের
খাটুনির পর কোথায় একটু ভালমন্দ খাব তা নয় — সব বরবাদ! শিবু আক্ষেপের সুরে গজর গজর করতে
লাগল।
থাপ্পর খেয়ে লিলি
রাগে কাঁপতে থাকে। তার ইচ্ছে হল শিবুকে চিৎকার করে বলে, ভাত দেবার মুরোদ নেই, কিল দেবার
গৌঁসাই! কিন্তু এই অপ্রত্যাশিত অপমান সে মুখ বুজে সহ্য করে নিল। গালটা কলতলায় ধুতে
গিয়ে হু-হু করে কেঁদে ফেলল। অনেকক্ষণ ধরে আপনমনে কাঁদল। গালের যেখানে শিবুর এঁটো হাতটা
সজোরে পড়েছিল সেখানে মাছের তৈলাক্ত ঝোলের দাগটা লেগে রয়েছে। জ্বালা করছে। তার মনে হল
নাড়ুর দেনা শোধ করতে গিয়ে যে দাগটা তার গায়ে লেগেছে এই দাগটা তার কণামাত্র নয়।
কালিনী, বইমেলা সংখ্যা, ২০১৩
No comments:
Post a Comment