প্রিয় রাত্রি,
বাড়ি ফিরতেই টানা কয়েকদিনের অন্তর্বিদ্রোহ
থেমে গেল; বারান্দায় গুটিসুটি মেরে ‘তুমি’ পড়ে রয়েছে। সত্যি,
আজকাল পিওনগুলো বড্ড বেশী অলস হয়ে পড়েছে। মনে মনে ব্যাটার শ্রাদ্ধ করলাম। অথচ ও
জানতেও পারল না যে, ও আমাকে কত বড় পুরস্কার দিয়ে গেল এতগুলো গালি খেয়েও। বেচারা!
তুমি তো এখন ঘুমের কোলে। আমি লেপের ভেতর নিজেকে ডুবিয়ে যুদ্ধ করছি নিজের সঙ্গে। চালে
হিমপতনের শব্দ হচ্ছে কেমন যেন মন-উদাস করা। টেপডেকে বাজছে মেহেদি হাসানের ‘তনহা তনহা মত্ সোচা
কর/ মর যায়ে গা’. . . (পুরো গানটা লিখে পাঠিয়েছিলাম, যাকে তুমি বলেছিলে
‘হাইলি পেনেট্রেটিং)। গজলকে তোমার মতই সঞ্চরণশীল বলে মনে হয় আমার। যেভাবে তোমার
প্রকাশভঙ্গিমায় মিশে থাকে প্রাণের টুকুরো, সমর্পণ ও প্রকাশের প্রস্তুতিপর্ব—
গজলের বিষন্নতা, সুরের ব্যাকুল আঘাত তেমনই ভরাট, পরিপূর্ণ। অনেকবার
পড়ে ফেলেছি তোমার চিঠিখানা; এখন ঘরময় উড়ছে তোমার
কথামেঘ, গোপন বৃষ্টি শ্লোগান।
বুকের ভেতর খালি খালি লাগে। আমার নিঃসঙ্গতা যেন প্রীতিভোজের আয়োজন করেছে। আসবে নাকি
?
ওহো, দেখলে তো ... ংড়ৎৎু, ংড়ৎৎু, বীঃৎবসবষু ংড়ৎৎু,
ঢ়ষবধংব ফড়হ'ঃ ংঁষশ — বিষন্নতার কথা আর বলব না, আসলে রাত্রি এতসব যে বলার তাগিদ, কেন ? সেই তো পারস্পরিক উত্তাপে
আÍজাগরণ, মনের মনকে সংরক্ষণের কি আন্তরিক প্রচেষ্টা। নয় কি ? জীবনের প্রতিটি পর্ব,
প্রতিটি ধাপ, সাফল্য, ব্যর্থতা, প্রাপ্তির পেছনে— চেতন বা অবচেতনে— সেই সংরক্ষণের টেনশন
নিয়েই তো হাজার হাজার আমি, হাজার হাজার তুমি মুহূর্ত-সময়-কাল চুষে চুষে খায়। বুদ্ধদেব গুহ’র ‘সবিনয় নিবেদন’
ও ‘একটু উষ্ণতার জন্য’ এর মধ্যেই আবার পড়লাম। এবার নতুন এক উপলব্ধি
হল। মনে হল, হৃৎপিন্ডের চেয়ে বড় জুয়া বোধহয় দুনিয়ায় খেলা হয় না। তুমি আবার
জানতে চেয়েছো রাত্রি, যে, কতটা তোমার পাশে আছি।
উত্তর দিইনি, আজ বলি, প্রশ্নটা ফবষরনবৎধঃবষু এড়িয়ে গিয়েছিলাম। অপঃঁধষষু-এর কোন উত্তর নেই আমার কাছে, কিছু মনে কোরো না।
তোমাকেও কখনো এধরণের প্রশ্নের জালে পাল্টা জড়াব না। এই বিশ্বায়নের যুগে ভালবাসা মাথার
খেলা, ঈধষপঁষধঃরাব চৎধমসধঃরংস,
হৃদয়প্রসূত কাঁপন কই ? কোথায় সেই রঙীন শূন্যতা, যার চরিত্র ন্যাশনাল
হাইওয়ের মতন। যার বাঁকে বাঁকে নিজের সঙ্গে
দেখা হয়ে যাওয়া। এত বাহ্যিক আড়ম্বর যে ব্যক্তিগত স্মৃতি থাকছে না।
লাইফ এত ফার্স্ট
যে ‘এতদিন কোথায় ছিলেন’-এর মতো নিজস্ব নিরালা নেই। কি লাভ, রাত্রি ? আধুনিক মানুষ তো ‘কাম’ ও ‘রিরংসা’কে প্রেম বলছে। এই
তো আজকের প্রেমের সংজ্ঞা, রূপ— জল ও তেল যে বিন্দুতে এসে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকে। যে বিন্দুর কথা
বললাম রাত্রি, ঠিক সেখানে তোমাকে বসিয়ে দেখেছি। ঝরসঢ়ষু কষ্ট হয়, খুব, কান ও গাল গরম হয়ে
ওঠে। আসলে তুমি মানসিক উর্বরতা। আমার নিজস্ব আয়না। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মাঝরাতে কবিতা
লিখতে বসে দেখেছিলেন যে সমস্ত শব্দ অক্ষর কমা কোলন ড্যাশ, এমনকি র-এর ফুটকিও
ঘুমন্ত ‘নীরা’কে লক্ষ্য করে ছুটে যাচ্ছে। অনেক ভেবেছি মাঝরাতে ঝিম মেরে বসে
থেকে, আমার তেমন হয় না। কি হয় বলো তো ? আমার বোধ ধারালো হতে হতে একসময় তোমার ঘুমে
রূপান্তরিত হই। আর দেখি রাত দুটোর শুনসান পরিবেশে বেশ্যাগলির মুখে বসে থাকা সেই ধবধবে
শান্ত বেড়ালটার মতো অদ্ভুত তুমি : বর্ণনা বা ব্যাখ্যার বহুদূরে থেকে আমাকে বোধহীন করে
ফেলেছো।
তোমার প্রবাদের মতো লাইনটি, ‘তোমার দুঃখগুলো রান্না
করে খাব’— আমাকে আজ আর বোধহয় ঘুমোতে দেবে না। তুমি নিজেও জানো না কতটা বিশুদ্ধ নারীত্বে ভরে আছে লাইনটি। যেমন সেদিন
পৌঁছতে দেরি হল, পাক্কা সাতচল্লিশ মিনিট অপেক্ষা শেষে তুমি ভীষণ শীতল স্বরে,
রাগ না করে বলেছিলে, ‘মনে হচ্ছিল জীবন ট্র্যাফিকের কূটিল চক্রান্তে ফেঁসে ছিল’
রাত্রি, আমার চাওয়া-পাওয়াগুলোর চরিত্র আজকাল ক্রমশ পাল্টে যাচ্ছে। তারা
যেন কিরকম হয়ে উঠছে— বুঝতেই পারছি না।
পরশু কলকাতায় ইন্টারভিউ, কালই বিকেলের ট্রেনে
রওনা হচ্ছি। তারপর দিদির বাড়ি যাব। তোমার জন্মদিনে এবার শুধু কাছছাড়াই নয়, শহরছাড়াও। সেদিন জেগে
থেকো, ফোন করব রাত্রি বারোটা এক-এ আর চুপ করে থাকব দীর্ঘক্ষণ। শব্দহীনতার পথে হাঁটতে
হাঁটতে তুমি খুঁজে নেবে আমার কথামালা। তোমার জন্য গাঢ় নীলরঙা দামী চুড়ি আনবো,
আর দুটো পার্কার পেন।
ভেজা
ভালবাসাসহ—
তোমার,
স্বপ্ননীল
পুনশ্চ : মন্দাক্রান্তা সেনের ‘হৃদয় অবাধ্য মেয়ে’
ও আবুল বাশারের ‘স্পর্শের বাইরে’ উপন্যাস, এবং গুলজারের বৃষ্টি-বিষয়ক
গানের সংকলন সৌমনার কাছে রেখে যাব। ওর বাড়ি গিয়ে সংগ্রহ করে নিও।
বিবর, এপ্রিল
২০০৫ । বিবর আয়োজিত প্রেমপত্র লেখা প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত চিঠি।
পুরস্কার মূল্য : এক হাজার টাকা।
No comments:
Post a Comment