একুশে ফেব্রুয়ারী — আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা
দিবস। ১৯৯৯ সালের নভেম্বর মাসে ইউনেস্কো তথা রাষ্ট্রসংঘ একুশে ফেব্রুয়ারীকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা
দিবস’—এর সম্মান দেওয়ার পর ২০০০ সাল থেকে দিনটি সারা বিশ্বে যথাযথ মর্যদায় উদ্যাপিত হয়ে
আসছে। ক্রববর্ধমান বিশ্বায়নের ফলে প্রবলতম
ভাষা ও সংস্কৃতির চাপে পৃথিবীর বহু ভাষা বিলীন হয়ে গিয়েছে। বর্তমানে আরও অনেক ভাষা
বিলীন হওয়ার প্রান্তসীমায় অবস্থান করছে। এ অশুভ প্রক্রিয়ারোধকল্পে সারা বিশ্বের জনগণের
মধ্যে সচেতনতা আনয়নের লক্ষ্যে রাষ্ট্রসংঘ প্রতি বছর ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা
দিবস’ পালনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। এই প্য়োজনীয়তায় প্রেক্ষাপটেই রাষ্ট্রসংঘের নির্বাচকমন্ডলী
‘একুশে ফেব্রুয়ারী’কে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসাবে বেছে নেন।
২১শে (একুশে) ফেব্রুয়ারী দিনটি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা
দিবস’ হিসেবে মর্যাদা পাওয়ার পেছনে অবশ্যই সঙ্গত
কারণ রয়েছে। ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে ব্রিটিশ ভারত দ্বিখন্ডিত হওয়ার মাধ্যমে ‘ভারত’ ও ‘পাকিস্তান’
নামক দুটো রাষ্ট্র স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীনতার লাভের অব্যবহিত পরেই পাকিস্তান
রাষ্ট্রের অন্যতম প্রদেশ পূর্ব পাকিস্তান (পূর্ববাংলা) এর ওপর পাকিস্তানি শাসকেরা বাংলা
ভাষার পরিবর্তে উর্দু ভাষা চাপিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ব
বাংলার জনসাধারণ মাতৃদুগ্ধের সমতুল্য মাতৃভাষা বাংলাকে কোন মতেই বিসর্জন দিতে রাজি
হননি। তাই তারা মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষার আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়েন এবং ১৯৫২ সালের
ফেব্রুয়ারী মাসে তার পরিপূর্ণতা লাভ করে। মাতৃভাষা বাংলার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেতে
পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিকে তার বুকের তাজা রক্ত দিয়ে রাজপথকে পিচ্ছিল করতে হয়েছে —
১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী। ইতিপূর্বে মাতৃভাষার জন্য এরকম রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের
কোনও নজির ইতিহাসে ছিল না। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী/ আমি কি ভুলিতে পারি’?
— আমরা যে ভুলতে পারিনি তার প্রমাণ সেদিনের ভাষা আন্দোলনের শহিদদের ঘাতকদের হাত থেকে
রাষ্ট্রক্ষমতা কেড়ে নিয়ে ১৯৭১ সালে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা।
১৯৫২ সালের পর থেকে পূর্ব বাংলা তথা পূর্ব
পাকিস্তানে (পরবর্তীকালে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ) একুশে ফেব্রুয়ারী ভাষা শহিদ দিবস
হিসেবে উদ্যাপিত হয়ে আসছিল। ভারতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন বাংলাভাষাভাষি অঞ্চলেও একুশে ফেব্রুয়ারী
দিনটিকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হতে থাকে। কেননা, একুশে ফেব্রুয়ারী হচ্ছে
—আত্মিক জাগরণের বিস্ফোরণ — একটি হৃদয়ের বিস্ফোরণ-বাঙালির হৃদয়, বাংলা হৃদয়। ১৯৯৯ সালের
নভেম্বর মাসে রাষ্ট্রসংঘের নির্বাচকদের কাছে যখন ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা
দিবস’ উদ্যাপনের জন্যে ‘দিবস’ নির্ধারণের প্রসঙ্গটি এলো, তখন তাঁরা প্রকৃষ্টতম
দিবস হিসেবে ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’কেই বেছে নেন।
২০০০ সাল থেকে শুধু সারা বিশ্বের বাংলা ভাষাভাষীরা
নন, ছোট-বড় সকল ভাষাভাষী মানুষ তথা সকল দেশ ও জাতি ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’কে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা
দিবস’ হিসেবে উদ্যাপন করে আসছেন। তাই একুশে ফেব্রুয়ারী বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে
থাকা সকল বাংলা ভাষাভাষীর গর্বের দিন।
বাংলা ভাষাভাষী মানুষের ভাষাপ্রেম সর্বজনবিদিত।
বহুভাষিক রাষ্ট্র বা রাজ্যে কোন একটি ভাষাকে
জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার যে বিষময় ফল সৃষ্টি করতে পারে একুশে ফেব্রুয়ারীর পাশাপাশি তার
আরও একটি জ্বলন্ত উদাহরণ উনিশে মে। উভয় ক্ষেত্রেই অবদমিত ভাষাটি ছিল বাংলা। ১৯৬১ সালের
১৯শে মে অসমের শিলচর শহরে মাতৃভাষা বাংলার সম্মান রক্ষা করতে গিয়ে ১১ জন শহিদ হয়েছিলেন।
ভারতের অসম রাজ্যের পাশাপাশি বিহার, ঝাড়খন্ড ইত্যাদি রাজ্যের বাংলাভাষীদেরও মাতৃভাষা
বাংলার মর্যাদা রক্ষার আন্দোলনের কথা এখানে উল্লেখ করা যায়। অবশ্য সকল বাংলাভাষী তথা বাঙালির ভাষা-প্রেম অমর একুশে
ফেব্রুয়ারীকে কেন্দ্র করেই দেশ ও রাষ্ট্র পরিচয়ের সীমানা ডিঙিয়ে ভাষা দিবসকে আন্তর্জাতিক
বাঙালির সর্বজনীন দিবসে পরিণত করেছে। বাঙালি হিসেবে নিঃসন্দেহে এটা আমাদের পরম গর্বের
বিষয়।
আমাদের মাতৃভাষা বাংলার শক্তি, সৌন্দর্য, ভাবব্যঞ্জনা অসীম।
স্বাধীন ভারতের অধিবাসী হয়েও পশ্চিমবঙ্গবাসী তথা বাংলাভাষী হিসেবে আমাদের অতিরিক্ত
গর্ব করার আরও অনেক বিষয় রয়েছে। স্বাধীন ভারতের জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা বাংলা ভাষার
সর্বশ্রেষ্ঠ কবি তথা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১)। স্মর্তব্য, স্বাধীন বাংলাদেশের
জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতাও কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পশ্চিমবঙ্গের প্রতিবেশী রাজ্যগুলোর
(যেমন ওড়িশা, অসম, বিহার, ঝাড়খন্ড ইত্যাদি) ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশ ও সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে
বাংলাভাষা ও সাহিত্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যথেষ্ট অবদান রেখেছে। পশ্চিমবঙ্গবাসী হিসেবে
এসব ঘটনা আমাদেরকে গর্বিত করে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য এই যে, পশ্চিমবঙ্গের দৈনন্দিন
কাজকর্মে মাতৃভাষা বাংলা ভীষণভাবে অবহেলিত। হিন্দি ও ইংরেজির মোহে বাংলা ভাষার স্বাভাবিক
মর্যাদা সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষই লজ্জাজনক ভাবে উদাসীন। তাদেরকে
আমরা মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিম (সতেরো শতক)-এর নিম্নোক্ত শ্লেষাত্মক পংক্তিমালা স্মরণ
করতে অনুরোধ করি—
‘যে সব বঙ্গেতে জন্মি
হিংসে বঙ্গবাণী। / সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।
দেশি ভাষা যার মনে
ন জুয়ায়। / নিজ দেশ ছাড়ি কেন বিদেশ ন যায়।।’
ভাষার শক্তি অদ্ভুত। ভাষা আনে ঐক্য,
ভাষা আনে বিভেদ। ভাষার এই বিপরীতমুখী ব্যবহার ও সংবেদনশীল চরিত্রকে মনে রেখেই ভাষার
প্রতি সহমর্মিতা বোধের প্রয়োজন। বাংলা ভাষার জন্য একুশে ফেব্রুয়ারী বা উনিশে মে সৃষ্টি
হতে পারলে, অন্য ভাষার জন্যেও যে কোন এক ভাষা শহিদ দিবসের সৃষ্টি হবে না
এমন কথা বলা যায় না। তাই, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস একুশে ফেব্রুয়ারীতে শুধু বাংলা ভাষার
জন্য নৃত্যগীত না করে বহুভাষী ভারতের অন্যান্য ভাষার মানুষদেরও আমাদের কাছে টানতে হবে।
কেন না, ভাষা-সাম্প্রদায়িকতা আর ভাষা-ভালবাসা এক নয়। সে জন্য বাংলা ভাষা
বিপর্যয়ের জন্য শুধু অন্যকে, বিশেষ করে হিন্দি ও ইংরেজিকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। বরং অন্যান্য ভাষাভাষী মানুষদের সঙ্গে সম্পর্ক গাঢ়তর
করে তুলতে হবে। এতে বাঙালি বাঁচবে বই মরবে না। পাশাপাশি ভারতের মতো বিশাল দেশের জাতীয়
ঐক্যও অনেকখানি সুরক্ষিত ও সুসংহত হবে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রসূতি —
মহান বাংলা ভাষার পতাকাধারী হিসেবে আমাদের পক্ষে এর মাধ্যমে ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের
শহিদ ভাইদের প্রতিও যথাযথ শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা সম্ভব হবে।
––––––––––––––––––––––––––––
কালিনী, জানুয়ারী ২০১০
No comments:
Post a Comment