September 6, 2014

গদ্য / আমার প্রেম / বিনয় ভূষণ বেরা


প্রেম করা সই আমার হল না
আজি হইতে প্রায় চল্লিশ বৎসর পূর্বের কথা বলিতেছি। আমি তখন ষষ্ঠবর্ষীয় বালকমাত্র। বিদ্যালয়ের প্রথম সারির বেঞ্চে বসিয়া দ্বিতীয় পিরিয়ড-এর মধ্যবর্তী শিক্ষকবিহীন সময়টিতে গাহিয়া উঠিলাম—  ‘আষাঢ় শ্রাবণ   মানে নাত মন। মণিহার চলচ্চিত্র তখন বাজারে হিটকরিয়াছেতাহার গান লোকের মুখে মুখে। শুনিয়া শুনিয়া আমিও দু-এক কলি রপ্ত করিয়া ফেলিয়াছিলাম। চক্ষু মুদিত করিয়া সংগীত সাগরে নিমগ্ন হইয়াছিএক ধাক্কায় চটক ভাঙিয়া গেল। আমার সমপাঠী প্রসাদ আমার চাইতে এক বৎসরের বড়। আমরা বলিতাম পেসাদ’, আমাকে সতর্ক করিতেছেজানিস এসব প্রেমের গান, ইসকুলে গাইতে নাই। যতদূর স্মরণ করিতে পারি প্রেমশব্দটির সহিত সেই আমার প্রথম পরিচয়। শুনিলাম কিন্তু হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিলাম না। স্পষ্ট বুঝিলাম অজ্ঞাতসারে এক নিষিদ্ধ আঙিনায় অনধিকার পদার্পণ করিয়াছি, শঙ্কিত  বক্ষে নিজেকে সংবৃত করিলামনা জানি কী মারাÍক ব্যাপার ঘটিয়া যায়!
আজিকার তরুণ পাঠকপাঠিকাগণ ভাবিতে  পারেনএই সামান্য ব্যাপারে এত ভ্যানতাড়া কিসের’ ? তাঁহাদের স্মরণ করাইয়া দিবচল্লিশ-পঞ্চাশ বৎসর পূর্বে চলচ্চিত্র, দূরদর্শন সিডি-ডিভিডির এমন দৌরাত্ম্য চালু হয় নাই। তিন বৎসরেরর শিশুর মুখে দিল’ ‘প্যারশব্দের হরবখ্ত প্রয়োগ অকল্পনীয় ছিল এবং স্কুলছাত্রের পক্ষে প্রেমশব্দটির উচ্চারণও ছিল অত্যন্ত দুঃসাহসপ্রযুক্ত।
যাহাই হউক, ‘প্রেমশব্দটির সহিত পরিচয় হইল, কিন্তু তাহার স্বরূপ সেই সময়ের কথা অবান্তর, আজিও ঠিকমতো বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না।
এস্থলে স্বীকার করিবআমি বেশ অকালপক্ক ছিলাম। যদিও অন্যরা তাহা অনুধাবন করিতে পারিতেন না। সপ্তম শ্রেণী হইতেই বড়দের পুস্তক পাঠ করিতে আরম্ভ করিলাম। এবং অচিরেই প্রেমের পুঁথিগত বিদ্যায় পোক্ত হইয়া উঠিলাম। ক্লাস এইটে সমরেশ বসুর বিশেষ বিশেষ রচনাগুলি এবং আরব্য রজনী শেষ করিলাম এবং মাফ করিবেন (এক পংক্তিতে রাখিতেছি বলিয়া) মহাভারতও আদ্যপান্ত (অবশ্য কাশীদাসী) শেষ করিয়া ফেলিলাম। অতএব প্রেমের দৈহিক সম্পর্ক সম্বন্ধেও একটা স্বচ্ছ ধারণা জন্মিয়া গেল। আর এই বইপড়াবিদ্যার ভালমন্দ এতটাই বুঝিয়া ফেলিলামবাস্তবে আর প্রেমের চৌকাঠ ডিঙাইতে পারিলাম না।

২ ॥ 
প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে

অষ্টম শ্রেণী উত্তীর্ণ হইতে না হইতেই এতটাই পরিপক্ক হইলামযত্রতত্র প্রেম দেখিতে পাইতাম। বিদ্যালয়ে (আমাদের বিদ্যালয় শুধুমাত্র বালকদের জন্য নির্দিষ্ট ছিল) ভাল ছেলে’  বলিয়া সুনাম থাকার কারণে পার্শ্ববর্তী বালিকা বিদ্যালয়ে সরস্বতী পূজার নিমন্ত্রণপত্র প্রদানের দায়িত্ব আমার উপরেই পড়িত। ঐ বিশেষ বিদ্যালয়ে প্রবিষ্ট হইতেই আমার হৃদস্পন্দন বাড়িয়া যাইত। স্পষ্ট বুঝিতে পারিতাম অজস্র যুগল চক্ষুর দৃষ্টি আমার দিকে নিবদ্ধ হইয়া আছে কোনক্রমে বারান্দা অতিক্রম করিয়া বড়দিদিমণির টেবিলে কার্ডখানি দিয়াই পলাইয়া বাঁচিতাম। এই বুঝি কেউ আমার প্রেমে পড়িয়া গেল! কিন্তু আমি অনেক শিখিয়াছি (বইপড়া বিদ্যায়)। অতএব, অকারণ গাম্ভীর্যের মুখোশে নিজেকে আবৃত রাখিয়া ঐ প্রলয়ঙ্করী জাতি হইতে স্পষ্ট দূরত্ব রক্ষা করিয়া চলিতাম।
কিন্তু প্রেমহইতে নিস্তার কোথায় ? ডম্বুর শাখায় টুনটুনির ব্যস্ততা হইতে ক্ষেত্র সঞ্চিত বাড়ির উপর রবিরশ্মি পতনের দৃশ্যসবকিছুর প্রতিই এক অনাস্বাদিত আকর্ষণ অনুভব করিতে লাগিলাম।
রবীন্দ্রনাথ জীবনানন্দের প্রেমে পড়িলাম, নিখিল ব্যানার্জীর প্রেমে পড়িলাম, সন্ধ্যা মুখার্জীর প্রেমে পড়িলাম। আর প্রেমে পড়িলাম রাধাকৃষ্ণের। চন্ডীদাস বিদ্যাপতি জ্ঞানদাসের সংস্পর্শে আসিলে ঘন্টার পর ঘন্টা ব্যয় হইয়া যাইতস্কুলের পড়াশোনা এবং অন্যান্য কাজ মাথায় উঠিত। তবে যার প্রেমে একেবারেই উন্মাদ হইলাম তিনি নিছকই এক জড়বস্তু কারুপূর্ণ এক চর্মকন্দুক। প্রত্যহ অন্তত একবার তাঁহার সান্নিধ্যে না আসিলে জীবন বৃথা বোধ হইত। কোন কর্মে মন বসিত না। এবং হৃদয়ের একটি অংশে শূন্যতা বোধ করিতাম। (অনেক পরে পরিণত বয়সে চিকিৎসকের পরমর্শে যখন তাহার সহিত চিরবিচ্ছেদ ঘটিয়া গেল তখন আমি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হইয়া পড়িয়াছিলাম) ইতিমধ্যে ফ্রয়েড শেষ করিয়াছি। তবুও প্রেমে দৈহিক ব্যাপারটিতে তখনো তেমন আগ্রহ জন্মে নাই। মনে হতো শরীর অর্থই  লাম্পট্য, অশুচিতা। তখন প্রেমমানেই এক  অনাবিল পবিত্র প্লেটোনিক ভাব। চন্ডীদাসের ভাষায়কামগন্ধ নাহি তার।প্রেম এবং কাম-এর স্বরূপ অন্বেষণে ব্যস্ত হইলাম। কাম ব্যতীত প্রেম সম্ভব  কিনা, পন্ডিতজনের উপলব্ধি হইতে তাহারই জ্ঞান আহরণ করিতেছি। হাইনরিখ হাইনের একটি  কবিতার অনুবাদ দেখিলাম (কার অনুবাদ, এখন মনে নাই)
     ‘‘কাইল জনেক জনহিতৈষী, ‘সেই প্রেম, যাহা দহে না দেহ।
          পতœী তাহার হাসি চাপিলেন—         
              তাঁর চেয়ে বেশি বোঝে কি কেহ ?’’
পরবর্তী কালে নীরদ সি চোধুরী মহাশয়ের রচনায় দেখিলামতিনি তাঁর স্বভাবসিদ্ধ রসে বশে ব্যাখ্যা করেছেন— ‘ধেনো মদ এবং উচ্চশ্রেণীর কানিয়াকে যে তফাৎ, ছোটলোকের কাম এবং ভদ্রলোকের কামে ঠিক সেই তফাৎ।’’ ‘ভদ্রলোকের কামবলিয়া সম্ভবতঃ তিনি প্রেমকেই নির্দেশ করিয়াছেন, যাহাতে দেহাতীত কিছু ব্যাপারও বিদ্যমান।
মাধ্যমিক শেষ হইতে না হইতেই বৈষ্ণব পদাবলী, গীতগোবিন্দের রসে জারিত হইয়াছিএও এক প্রেম। শরৎ-বঙ্কিমের প্রেমপর্ব আগেই চুকিয়া গিয়াছে। এর কোনটিতেই কামের  আঁশটে গন্ধ পাই নাইএমন মিথ্যাচার করিতে পারিব না।

৩ ॥
যদি প্রেম দিলে না প্রাণে

বস্তুত নবম শ্রেণী হইতে দ্বাদশ শ্রেণীতে ছাত্রাবস্থায় সকল কিছুই প্রেমময় দেখিতাম। তবু হায়বৃথা যায় যৌবন মননপ্রেমে পড়িতে পারিলাম না। যে অজস্র প্রেমের অযুত তীক্ষè শর প্রতিনিয়ত আমার চিত্ত  তাক করিয়া ধাবিত হইতেছে তাহার কিয়দংশও লক্ষ্যভ্রষ্ট না হইলে এতদিনে হয়তো অন্ততঃ কোন একটা বিষয়ে কেউকেটাহইয়া উঠিতাম। না হইয়া কেবল হা-হুতাশই সম্বল। আজিও এই প্রৌঢ় বয়সেও প্রভাতকালে প্রাইভেট টিউশনিগামী কিশোর-কিশোরীর দিকে নির্নিমেষ চাহিয়া থাকি। কোন কিশোর হয়তো তাহার দ্বিচক্রযানটিকে হাঁটাইয়া লইয়া বা অত্যন্ত ধীরগতিতে চালনা করিয়া পার্শ্ববর্তিনীর সহিত একান্ত আলাপ চারিতায় মগ্ন। আক্ষেপ হয়হায়, আর একবার যদি প্রাইভেট  টিউশনি পড়িতে পাইতাম !
ঈশ্বর বলিয়া যদি কেহ থাকেনতাঁর কাছে একটিই অভিযোগএই চক্ষুদুটি কেন আমাকে দিয়াছেন ? — যদি প্রেম দিলে না প্রাণে’ ?

––––––––––––––––––––––

বিবর, এপ্রিল ২০০৫

No comments: