দোসরা অক্টোবর ২০০৯ ভোরে নগর-সংকীর্তনের শব্দে
ঘুম ভেঙে যায়। পুজোর ছুটিতে সুদূর রাজস্থানে বেড়াতে এসে মাউন্ট আবুতে নাকি লোকের ঠিক
সামনে হোটেল পানঘাটের দোতলার একটি ঘরে শুয়েছিলাম। পাশের বিছানায় আগের দিনের ঘোরাঘুরিতে
পরিশ্রান্ত স্ত্রী ও কন্যা তখনও ঘুমোচ্ছে দেখলাম।
রাজস্থানের মানুষজন এত ভোরে নগর-সংকীর্তনে বেড়িয়েছে। দৃশ্যটি দেখবার আগ্রহ অনুভব করলাম।
নগর-সংকীর্তন তো আমাদের শহর শিলিগুড়িতে সচরাচর দেখা হয় না। ছোটবেলায় অবশ্য ছেড়ে আসা
পূর্ববঙ্গের দেশের বাড়িতে নগর-সংকীর্তন দেখতে পেতাম — কার্তিক কিংবা বৈশাখ
মাসে। কেমন যেন একটা ভাললাগার মৌতাত পেয়ে বসলো। একাই বিছানা ছেড়ে নেমে এসে দরজা খুলে
বারান্দার রেলিং-এ এসে দাঁড়ালাম। পাহাড় ঘেরা ভোরের নাক্কিলেক হাল্কা কুয়াশার মাঝে জেগে
উঠছে। সামনের রাস্তায় সামান্য কিছু মানুষের চলাফেরা শুরু হয়েছে। নিচের চায়ের দোকানী
তার দোকানের ঝাপটিও সম্ভবতঃ সবে খুলেছে। চা-প্রত্যাশী দু-একজন খদ্দেরও দেখলাম দাঁড়িয়ে।
লেক সংলগ্ন গাছালিযুক্ত পার্ক ও নৌকাঘাট তখনও শুনশান। স্বখ্যাত টড্ রকের ছায়া জলে পড়েছে।
রাজ-হাঁসগুলোও সাড়া-শব্দ জুড়ে দিয়েছে। এমনই এক মুগ্ধকর পরিবেশে পাশের মূল রাস্তা দিয়ে
দেখি সাকুল্যে পাঁচ-ছয়জন সাবেকী কুর্তা-পাজামা-পাঞ্জাবী পরিহিত বৃদ্ধ-তাদের কারও মাথায়
স্বদেশী যুগের গান্ধী টুপি পড়া, তাঁরা ছোট হারমনিয়াম
গলায় ঝুলিয়ে ঢোলক সহযোগে কীর্তন গাইতে গাইতে এক সময় লেকের সামনে এসে দাঁড়ালেন। তাঁদের
কীর্তনের কথাগুলি বুঝবার চেষ্টা করি মনোযোগ দিয়ে। কাছে এলে বোঝা গেল তাঁরা ‘রঘুপতি রাঘব...’
গাইছেন। মনে বিদ্যুতের ঝলক খেলে গেল। আরে, আজ তো গান্ধীজীর জন্মদিন।
সুদূর রাজস্থানের এই শৈল শহরে সবাই যখন ভোরের সুখ-নিদ্রায় মগ্ন, তখন এই কজন প্রবীণ
মানুষ গান্ধীজর স্মরণে রেখে পথে নেমে রামধূন গাইছেন — তাঁদের শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন।
গান শেষে তাঁরা স্লোগান দিতে থাকলেন — ‘গান্ধীজী কি জয়’ ‘যবতক চাঁন্দা-সুরজ
রহেগা — গান্ধীজী কা নাম রহেগা’ ইত্যাদি। লেকের ডানপাশে
‘ভারত-মাতা’ মন্দিরের দিকে তাকালাম। বেশ কয়েকটি সিংহেটানা রথে ভারত-মাতা
তাঁর দিগি¦জয়ের রথ ছুটিয়েছেন।
আমার দুষ্টু মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। প্রায়
হাজার মাইল দূরে পূর্ব সীমান্তে শিলিগুড়িতে আমার এক শালীকে ফোনে সংবাদটা দিতে ইচ্ছে
হল। ওর সাথে আমার খুনসুুটির সম্পর্ক। এই ভোরে ফোনে ওর ঘুমটাই ভাঙানো যাক্। ঘরে ঢুকে
মোবাইলের বোতাম টিপলাম। ওপার থেকে একসময় ঘুম জড়ানো কন্ঠস্বর ভেসে এলো — হ্যালো কে?
আমি বলি— আপ ক্যায়া শোয়ে হেঁ ? উঠ্ খাড়ি হো যাও,
উত্তর আসে — এ্যাঁ ? কে ?...
অমি বলি — আজ বাপুজী কা জনম দিন
হ্যায়। উঠ খাড়ি হো যাও, আরাম হারাম হ্যায় না? ইস্ লিয়ে —
এবার বুঝতে পারে। আলস্যভরা সুরে বলে —‘ও — প্রবাস দা,
উঠে তো পড়েছি। না উঠে উপায় আছে ? জানোই তো — আমার উনির বেড-টি না
হলে... ডাক আসে না। তা তোমরা এখন কোথায় ?’
— কোথায় আবার, মাউন্ট আবুতে। রামধুন
জানো ?
শালী বোকার মতো উত্তর দেয় — কী-ই-ই ?
আমি বৃদ্ধদের গাওয়া ‘রঘুপতি রাঘব রাজারাম...’
দু-লাইন গেয়ে শোনালাম।
‘সকালবেলা কি সুন্দর শুনলাম...’ কথাগুলি ভেসে আসতেই
মোবাইলের লাইন কেটে গেল। পাশের বিছানায় তখনও স্ত্রী ও কন্যা অঘোরে ঘুমিয়ে।
আমার মনে হলো — গান্ধীজীর নামে জয়ধ্বনি
দেওয়া ঐ গুটিকয় বৃদ্ধদের মতো শালীকে রামধুন শুনিয়ে আমিও সামান্য কিছু পুণ্য অর্জন করলাম
নাকি লেকের এই সুন্দর ভোরবেলায়।
––––––––––––––––––––––––––––
কালিনী, জানুয়ারী ২০১০
No comments:
Post a Comment