সর্বাণী এবারও পাশ করতে পারেনি।
তার মানে কলেজের আয়রন গেট পেরিয়ে সামনে খোলা
আকাশের বুকে অফুরন্ত আনন্দের জোয়ারে ভেসে যেতে পারবে না। কলেজের গন্ডী পেরিয়ে গেলে
আকাশের বুক চিরে প্লেনে বিদেশে পাড়ি দেওয়ার যে স্বপ্ন দেখে আসতো, তা আর হলো না। আর ফেল
করল কিনা ইংরেজীতে!
‘মতি ভিলা’র একমাত্র মেয়ে সর্বাণী।
যার রূপ, যৌবন আর আভিজাত্যের ছোঁয়া পেতে শহরের অনেক যুবক ছোঁক ছোঁক
করে। কলেজের ছাত্র নেতা থেকে শুরু করে ছোকরা লেকচারার, প্রফেসাররা পর্যন্ত
স্বপ্ন দেখে সর্বাণীর। অথচ সর্বাণী...।
শহরের প্রতিষ্ঠিত নামী এবং ধনী ব্যবসায়ী কানাইবাবু
গুম মেরে বসে আছেন। তার পাশে সর্বাণীর মা আর তাদের মুখোমুখি সোফায় সর্বাণী। ‘মতি ভিলা’র তিনজন প্রাণীর মনে
তিন রকম চিন্তাভাবনা। কানাইবাবুর তিনটি তেল মিল, দুটি চালকল,
একটি বিরাট চা বাগান আর ‘মতি পরিবহন’। এসবের উত্তরাধিকারী তার একমাত্র সন্তান সর্বাণী। তিনি তার
মাথার অল্প চুলে আঙুল ঘষতে ঘষতে নীরবতা ভঙ্গ করেন — আর একবার চেষ্টা করে
দ্যাখ মা...।
— হ্যাঁ, মন খারাপ করে আর কী
হবে! তুই বরং এখন থেকে লেগে পর। মেয়ের দিকে তাকিয়ে সস্নেহে বলেন কানাইবাবুর স্ত্রী।
যাকে উদ্দেশ্য করে বলা, সেই সর্বাণী কিন্তু
আশ্চর্যভাবে নীরব। মাথা নীচু করে পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে কার্পেটের উপর একটা বৃত্ত তৈরী
করতে ব্যস্ত। বৃত্তটি আঁকা হয়না বরং অলীক রেখাগুলি তার পায়ের বুড়ো আঙুলের পিছু পিছু
পাক খায়। সর্বাণীর চোখের সামনে তখন কলেজের কলাপসিব্ল গেটে ঝুলে থাকা বিরাট তালা আর
তার ভেতরে নিজেকে অসহায় বন্দিনীরূপে দেখতে পায়। গেটের বাইরে তারই সহপাঠী ছাত্র-ছাত্রীদের
উল্লাস, উচ্ছ্বল আনন্দেভরা চোখের ঝিলিক আর য়ুনিভার্সিটির পুষ্পরথে চাপার
জন্য আকুল হয়ে তাকিয়ে রয়েছে আকাশের দিকে...।
চকিতে সোজা হয়ে বসে স্থির চোখে মা-বাবার মুখের
দিকে তাকিয়ে সর্বাণী ছুঁড়ে দেয় নিজের কথা — আমি আর পড়বো না!
দীর্ঘ সময়ের জমে থাকা গুমোট নীরবতা মুহূর্তে
ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। কানাইবাবু আর তার স্ত্রী পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকেন।
সর্বাণী দুমদাম পা ফেলে ততক্ষণে দোতলায় নিজের ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। বিছানায়
উপুর হয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে।
সর্বাণীর মনে হয় তার চারদিকে এত চাটুকার ভোমরার
গুঞ্জণ শুধুমাত্র তার রূপ যৌবনের জন্য, নইলে ওদের দেওয়া নোটস, সাজেশান সব কিছু মিথ্যা।
সে আর পড়াশোনা করবে না। কী হবে লেখাপড়া শিখে ? নিজের ব্যর্থতায় নিজের
উপর একরাশ অভিমানে ফেটে পড়ে সর্বাণী। কোলবালিশটা সজোরে ছুঁড়ে দিয়ে কাঁদতে থাকে।
এমন সময় দরজায় ঠক্ ঠক্ শব্দ।
সর্বাণী চুপচাপ শুয়ে থাকে।
— দরজা খোল। আমরা তোর বন্ধু।
সর্বাণী সজোরে বালিশ আঁকড়ে ধরে প্রবল আক্রোশে
দলা পাকাতে থাকে। ওরা সবাই পাশ করেছে, কেউ কেউ ফার্স্ট সেকেন্ড হয়েছে। কলেজের ত্রিসীমানায়
ওদের আর কোনদিন দেখা যাবে না। সর্বাণীর চোখ ছল্ছল্ করে ওঠে।
— দরজা খোল মা। ওরা তোর সাথে দেখা করতে এসেছে। মায়ের গলা শুনতে
পায় সর্বাণী। অলস পায়ে দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়। দরজার ছিটকিনি খুলতেই জনা তিনেক যুবতী
হুড়মুড় করে ঘরে ঢোকে।
সবাই সর্বাণীর খাটে গিয়ে বসে। বিছানাপত্র
লন্ডভন্ড। সর্বাণীর আলুথালু বেশবাস। ড্রেসিংটেবিলের তলায় কোলবালিশ পড়ে থাকতে দেখে যুথিকা
আস্তে করে বলে, তোর কাছে এলাম রে... এত ভেঙে পড়লে চলে ? মন খারাপ করিস না।
আবার পড়াশোনা শুরু করে দে।
— তোর যা রূপ আর সম্পত্তি, বি.এ পাশ করাও যা,
না করলেও কিছু এসে যায় না। আমার মতো তোকে তো আর টিউশনি বা চাকরির জন্য হন্যে হয়ে
ঘুরতে হবে না। দেবী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আপন মনে বলে।
একমাত্র পূর্ণিমা কিছু না বলে চুপ করে থাক।
তার দিকে তাকিয়ে সর্বাণী ধরা গলায় বলে, কিরে তুই কিছু বল। আহা উঁহু কর। পূর্ণিমাই
একমাত্র ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করেছে চার বান্ধবীর মধ্যে। নামে পূর্ণিমা হলে কী হবে —
পূর্ণিমা চাঁদের মত মুখ বা গায়ের রং নয়। শ্যামলা, ছিপছিপে আর অপুষ্ট
গায়ের গড়ন। তবে ওর চোখ দুটো ভীষণ উজ্জ্বল আর বুদ্ধিদীপ্ত।
— কী আর বলব, বল! তুই পাশ করলে আমরা
সবাই খুশী হতাম। তুই পাশ করতে পারলি না কেন আমরা ভীষণ অবাক হচ্ছি। আর আমরাও আনন্দ করতে
পারছি না।
সর্বাণী এই প্রথম অনুভব করল, পূর্ণিমার কথায় কোন
ভেজাল নেই। রয়েছে আন্তরিকতা, সমবেদনা আর দুঃখবোধ। অথচ এই পূর্ণিমাকে নিয়ে চার বান্ধবীর মধ্যে
সবচেয়ে বেশী রগড় করতো সর্বাণী।
— নাহ, আর পড়বো না রে ?
পড়ে কী হবে। তোরা য়ুনিভার্সিটিতে পড়বি, ওতেই আমার আনন্দ। আর
তোরা থাকবি না, কলেজে ক্লাস করবো একা একা ? ওসব হচ্ছে না।
— শোন সর্বাণী। কলেজে যেতে হবে না। ডিসটেন্সে
পরীক্ষা দিবি, কলেজে ক্লাস করতে হবে না। দেবী ঘন হয়ে সর্বাণীর কাছে বসে বোঝায়,
তুই তো ইংরেজীতে ফেল করেছিস। ইংরেজীর বিভাগীয় প্রধানের কাছে কোচিং নে। নির্ঘাৎ
পাশ করবি।
— তুই কি এম.এস. এর কথা বলছিস?
— হ্যাঁ রে। সেই মানিক সেন, যে তোর দিকে জুলজুল
চোখে তাকাতো। শুনেছি তিনি নাকি ইংরেজীর হেড এগজামিনার। কলেজ য়ুনিভার্সিটির প্রশ্নপত্র
সিলেক্ট করেন, শুনেছি য়ুনিভার্সিটির ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের অনেক রীডার,
প্রফেসর তার বন্ধু। তিনি কোচিং দেবেন কিনা জানিনা। তবে তোর কথা আলাদা।
এম.এস. অর্থাৎ মানিক সেনের কথা উঠতেই সবাই
একযোগে হেসে ফেলল। কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে এম.এস একটি অতি পরিচিত এবং আলোচিত নাম।
বেঁটে খাটো আর অস্বাভাবিক মোটা। গায়ের রং কুচকুচে কালো আর রোমশ। মুখে একদলা মাংসপিন্ডের
আড়ালে দুটি অতি ধূর্ত চোখ।
এম.এস. খুব কড়া ধাতের অধ্যাপক। তাই ছাত্র-ছাত্রীরা
তাকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা, মস্করা করে নিজেদের মধ্যে। তার কাছে কোচিং নেবে সর্বাণী?
ছো: কদাকার কুৎসিৎ এক ভাল্লুক মানুষের কাছে কোচিং ? সে পরিস্কার জানিয়ে দিল— এম.এস. এর কাছে ও মরে
গেলেও কোচিং নেবে না।
সর্বাণীর কথা শুনে সবাই থ’ মেরে গেল।
পূর্ণিমা সর্বাণীর মনোভাব আঁচ করে খুব শান্ত
গলায় এবং প্রতিটি শব্দের উপর জোর দিয়ে বলে, লোকটা দেখতে কদাকার
হলে কী হবে — ইংরেজীতে যে বাঘা, একথা কলেজের সব্বাই একবাক্যে স্বীকার করেন।
এবং এটা সবাই জানে যে এম.এস এর সজেশান মানেই ইংরেজী পরীক্ষার সম্ভাব্য প্রশ্নপত্র।
— তুই তো আর প্রেম করতে বা ঢলাঢলি করতে যাচ্ছিস
না। দেবী ফিক করে হেসে ফোড়ন কাটে।
— তুই মাঠে নেমে পড় না। এম.এস. এখনও কনফার্মড
ব্যাচেলার। চিমটি কাটে যুথিকা।
— তোদের মতন ফর্সা আর গায়ে গতরে মাংস থাকলে
আমি চেষ্টা করে দেখতাম রে। পুরুষ মানুষের টাকা আর গুণ থাকলে অনেক রূপসী মেয়ে ঝাঁপ দেয়।
পিপিলিকা যেভাবে আগুনে ঝাঁপ দেয়।
তিন বান্ধবীর ঠাট্টা ইয়ার্কি ভরা হাসি হাসি
মুখগুলি একবার দেখে নিল সর্বাণী। ওরা তিনজনই পরীক্ষায় পাশ করে চাপা আনন্দে মশগুল। এতদিন
সে নিজেই ওদের আপদে বিপদে বুদ্ধি আর নানা পরামর্শ যুগিয়ে এসেছে, অথচ আজ তারাই তাকে
পরামর্শ দিচ্ছে...।
ততক্ষণে সর্বানীর মা ট্রেতে চা নিমকি নিয়ে
ঘরে ঢুকলেন। তিনজনই সমস্বরে হাঁ হাঁ করে ওঠে, একি মাসীমা —
এরই মধ্যে চা-টা নিয়ে এলেন ? কথাটা নিজেদের কানেই বেমানান শোনাল। এর আগে যতবার ওরা এসেছে,
মাসিমাকে চায়ের জন্য পীড়াপীড়ি করেছে।
সর্বাণীর মা ব্যথাতুর গলায় মেয়ের দিকে তাকিয়ে
বলেন, সর্বাণী পাশ করলে আজ অনেক কিছুই হতো রে মা। আজ শুধু চা খাও তোমরা।
— তুমি চুপ কর তো মা। খাট থেকে নেমে চা এগিয়ে
দিয়ে বলে সর্বাণী। দেখলি তো তোরা, মায়ের সবটাতেই বেশী বেশী। পাশ করতে পারিনি তার জন্য যতটা না
দুঃখ আমার হওয়া উচিত, তার চেয়ে বেশী দুঃখ ওনার।
ঘর থেকে বেরিয়ে সর্বাণীর মা একটা দীর্ঘশ্বাস
ছাড়েন। পাশ করতে পারলে অতনুর সাথে এই মাসের মধ্যেই মেয়েটার বিয়ে দেওয়া যেত। অতনু আর
ওর মায়ের পছন্দ হয়েছে। ছেলেটা বিদেশে চাকরি করে। কোন দাবী নেই তার। সর্বাণী শুধু সুন্দরীই
নয় অপরূপা। শর্ত শুধু একটাই— বি.এ পাশ করা চাই সর্বাণীকে।
অগত্যা ঠিক হল সর্বাণীকে সঙ্গে নিয়ে ওরা তিনজন
এম.এস. এর কাছে যাবে। যাতে তিনি সর্বাণীকে কোচিং দেন।
আশ্রমপাড়ায় তিনতলা বিরাট বাড়ি অধ্যাপক মানিক
সেনের। বাইরে নেমপ্লেটে লেখা ড. এম. সেন, বিভাগীয় প্রধান, ইংরেজী বিভাগ,
মেঘনাদ মেমোরিয়াল কলেজ।
তিন তলায় থাকেন অধ্যাপক মানিক সেন। ডোর বেল
টিপতেই এক সৌম্যকান্তি বৃদ্ধা দরজা খুলে হাইপাওয়ার চশমার ভেতর থেকে ওদের দেখে বললেন
— তোমরা কে গো বাছা ?
— অধ্যাপক সেন কি বাড়ি আছেন ?
— মানিক ? ওতো এখনও ফেরেনি। তা
কী দরকার ?
— মানে... আমরা ওনার স্টুডেন্ট। একটু দেখা করতে
এসেছিলাম। পূর্ণিমা বলে।
— আসার সময় তো হয়ে গেছে, তা —যদি খুব দরকার থাকে
আমাকে বলে যেতে পারো তোমরা।
ওরা নিজেদের মধ্যে ফিসফাস করে। কী করবে ভেবে
পায়না। ফিরে যাবে ? আবার কবে একসঙ্গে আসা হবে...। হঠাৎ সর্বাণী বলে — মাসীমা, ওনার সাথে খুব জরুরী
কথা আছে আমাদের। আমরা কি একটু অপেক্ষা করতে পারি ?
বৃদ্ধার চোখেমুখে বিরক্তির চিহ্ন স্পষ্ট।
একটু ভাবলেন। তারপর অনিচ্ছায় আহ্বান জানালেন, তাহলে তোমরা ভেতরে
এসে বসো। তিনি দরজা খুলে একপাশে সরে দাঁড়ালেন।
এক এক করে চারজনই ঘরে ঢুকল। ড্রয়িংরুমটা বেশ
পরিপাটি করে সাজানো। একপাশে কাঠের সেল্ফে মোটা
মোটা ইংরেজী বই সাজানো। কালো কাঁচের ডিম্বাকৃত ডাইনিং টেবিল এক কোণায়। দক্ষিণ জানালার
পাশে একটা টেবিল। সঙ্গে রিভলভিং চেয়ার। টেবিলে পেন স্ট্যান্ড, বইপত্র, ফাইল আর ল্যাপটপ। দামী
কাগজে ছাপা অয়েল পেন্টিং-এর মত একটি মাত্র সুদৃশ্য ছয় পাতার ক্যালেন্ডার। ক্যালেন্ডারের
ছবিটি একটি তরুণী মায়ের। কোলে ফুটফুটে বাচ্চা। ড্রয়িংরুমটা বেশ বড়। ওরা চারজনই যেন
মোহিত। দেবী সর্বাণীকে চিমটি কেটে বলল, ড্রয়িংরুমটা যদি এত ঝকঝকে সুন্দর হয়,
তাহলে লিভিংরুম মানে শোবার ঘরটা কেমন হবে রে ?
— তুই চট করে দেখে আয়না। পূর্ণিমা মুচকি হেসে
ফোড়ণ কাটে।
ওরা নীচু গলায় পরামর্শ করে এম.এস. এলে প্রথমে
কে কি বলবে। পরস্পরকে গুঁতোগুলি করে। এমন সময় হঠাৎ ডোরবেলের শব্দ হতেই সচকিত হয়ে নিজেদের
বেশবাস ঠিকঠাক করতে লাগল তারা।
সেই বৃদ্ধা দরজা খুলে দিলেন। কী যেন বলতে
যাচ্ছিলেন এম.এস., ড্রয়িংরুমে চার যুবতীকে বসে থাকতে দেখে সবিস্ময়ে বলেন —
আরে, তোমরা কতক্ষণ ?
—নমস্কার স্যার। সমস্বরে ওরা উঠে দাঁড়াল।
—বসো বসো। এই গরীবখানায় তোমাদের হঠাৎ আগমনের
হেতু... বলতে বলতে থেমে গেলেন এম.এস। সর্বাণী
অপলক তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে! সর্বাণী ছাড়া বাকি তিনজন মুখ টিপে হাসছে।
— একটু বসো, এক্ষুণি আসছি। বলেই
ঘরে ঢুকে গেলেন এম.এস.।
— তুই অমন হাঁ করে কী দেখছিলি রে সর্বাণী ?
পছন্দ তাহলে হয়েছে — যুথিকা অনুচ্চ গলায়
ফোড়ন কাটে।
— যা: তোদের সবটাতেই ইয়ে —
সর্বাণী কিন্তু পায়ের নখ দিয়ে একটা বৃত্ত
রচনা করতেই যেন ব্যস্ত। তার মাথায় তখন নানা ধরণের চিন্তাভাবনার আনাগোনা। এম.এস. রাজি
হবেন তো ? যদি রাজি না হন কোচিং দিতে, তাহলে ? ম্লান হেসে খুব আস্তে
করে বলে — পূর্ণিমা, কথাটা তুই তুলবি। ঠিক আছে ? মাথা দুলিয়ে আশ্বস্ত
করে পূর্ণিমা।
এম.এস.ঘরে ঢুকে একগাল হাসি মেখে সবার মুখের
দিকে তাকিয়ে বলেন — তা হঠাৎ কী মনে করে ?
সবাই নিরুত্তর। পরস্পরের মুখ চাওয়া চাউয়ি
করে। কিভাবে কথাটা পাড়বে ভেবে পায়না। হঠাৎ পূর্ণিমা গলা খাকারি দেয়, অর্থাৎ সে বলবে। খুব
সংযত এবং বিনীতভাবে বলে, স্যার আমরা আপনার কাছে এসেছিলাম —। আমাদের মধ্যে একমাত্র
সর্বাণী পাশ করতে পারেনি। ইংরেজীতে ফেল করেছে। তাকে যদি মাঝে মাঝে কোচিং দেন তাহলে
বেচারী ধন্য হয়ে যাবে। নইলে ও একটা অঘটন ঘটাবে। কথার মধ্যে যথেষ্ট আবেদন ছিল আর ছিল
আবেগ, যা অধ্যাপক মানিক সেন গভীরভাবে উপলব্ধি করে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন। তিনি সর্বাণীর
বাবা কানাইবাবুকে বিলক্ষণ চেনেন। শহরের প্রতিষ্ঠিত ধনী ব্যক্তিদের অন্যতম তিনি। তাদের
কলেজের উন্নয়নকল্পে প্রভূত দান করেছেন। কলেজের গার্লস কমনরুম বিল্ডিংটা তো কানাইবাবুর
দানেই তৈরী।
— কিন্তু আমি তো টিউশনি বা কোচিং দিই না। তাছাড়া
আমার সময়ই বা কোথায় ? নীরবতা ভঙ্গ করেন মানিক সেন।
একথা শোনার পর সবাই মুষড়ে পড়ে। পরস্পরের মধ্যে
দৃষ্টি বিনিময় করতে থাকে।
— না, মানে টিউশনি বা কোচিং
ঠিক নয়। ও মাঝে মাঝে আপনার কাছে আসবে আর আপনি শুধু ইংরেজিটা দেখিয়ে দেবেন। না করবেন
না, প্লীজ স্যার। যুথিকা ঝরঝরে গলায় কাতরায়।
এম.এস. এবার সোজাসুজি যুথিকার দিকে তাকিয়ে
বলেন — দেখ, সর্বাণী না কি যেন নাম, ওকে কলেজে দেখেছি।
মাঝে মাঝে আমার ক্লাসও করেছে। শুনেছি সে নাকি ইন্দ্রবাবুর ক্লাসে ভীষণ গন্ডগোল করে।
আমি যদিও ডিপার্টমেন্টাল হেড, তবুও ইন্দ্রবাবু ইংরেজীর অধ্যাপক হিসেবে খারপ নন। বয়সটাই যা
একটু কম। ভেরি এনারজেটিক ইয়ং লেকচারার। ওনার কাছেই বরং কোচিং নিক না। ততক্ষণে অধ্যাপকের
মা চায়ের ট্রে নিয়ে ঘরে ঢোকেন। বিস্কুটের প্লেট আর চায়ের কাপ নামিয়ে তিনি চলে যান।
— চা খাও তোমরা।
ওরা গুম হয়ে বসে রইল। সর্বাণীর মনে হলো,
সে আর কোনদিন কলেজের গন্ডী পার হতে পারবে না। এটা প্রায় সকলেরই জানা যে অধ্যাপক
মানিক সেন ক্লাসে ভীষণ সিরিয়াস। বাইরে খোলামেলা। কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা তার কিম্ভুতকিমাকার
বপু আর অসুন্দর চেহারা দেখে অনেকটা মজা করার জন্য আড়ালে আবডালে হাসাহাসি করে। ঠাট্টা
করে। বিভিন্ন ভূষণে ভূষিত করে নিজেদের মধ্যে আমোদ করে। তারাও কি কম মজা করেছে ?
কিন্তু আজ —
উপস্থিত সবাইকে স্তম্ভিত করে আচমকা এম.এস.
এর পা জরিয়ে ধরে সর্বাণী। কান্নায় ভেঙে পড়ে। কান্না মেশানো গলায় বলে— স্যার আপনি দয়া করে
আমায় ঠাঁই দিন।
অপ্রত্যাশিত এই ঘটনার জন্য অধ্যাপক সেন তৈরী
ছিলেন না। তিনি হকচকিয়ে যান। চেয়ার ছেড়ে উঠে সর্বাণীকে সান্ত¡না দেন— আহা করো কি ?
কেঁদো না, প্লীজ। বেশ, তবে সপ্তাহে দুদিন এসো। রোববার আর মঙ্গলবার — ও.কে ? নাউ গেট্ আপ লাইক আ
গুড গার্ল।
বিজয়িনীর হাসি হেসে মাথা দোলায় সর্বাণী। চোখ
মুছে ওঠে দাঁড়ায়। সবাই যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।
অধ্যপক সেনের বাড়ি থেকে বের হয়ে এসে পূর্ণিমা
জড়িয়ে ধরে সর্বাণীকে। বলে, উফ! দারুণ অভিনয় করেছিস রে।
— দূর, তোদের জন্য এসব করতে
হলো। যুথিকা চোখ টিপে একটা ইঙ্গিত করতেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল সবাই।
সর্বাণী অধ্যাপক সেনের বাড়ি সপ্তাহে দুই দিন
নিয়ম করে যেতে লাগল। উগ্র প্রসাধন, নতুন নতুন সাজগোজে যথাসম্ভব আরও মোহিনী করে তোলে নিজেকে। কোচিং-এর
ক্লাস নয়, যেন অভিসারে যাচ্ছে। আসল উদ্দেশ্য একটাই এম.এস. কে কুপোকাৎ করা।
নোট্স আর সাজেশান হস্তগত করা। যে করেই হোক — ওকে পাশ করতেই হবে।
অন্যান্য বিষয়গুলি তার কাছে তেমন কঠিন নয়, যতটা কঠিন ইংরেজীটা। ইংরেজীতে কোনমতে টপকাতে
পারলে ডিগ্রীটা হাতের মুঠোয়। কম্পালসারি সাবজেক্ট, নইলে—
অধ্যাপক সেন সর্বাণীকে সেক্সপীয়ার আর জর্জ
বার্নাড শ-এর ড্রামা, জন মিলটন, বায়রন, শেলী এবং রোমান্টিক কবি কীটস-এর পোয়েট্রি এত প্রাঞ্জল ভাষায়
বোঝাতে লাগলেন যে সর্বাণী অভিভূত। ইংরেজী বিষয় যে কত ইন্টারেস্টিং আর সহজ, সে কথা বারবার সর্বাণীকে
বলে তার কাল্পনিক ভীতি দূর করার চেষ্টা করেন। সর্বাণী হাঁ করে গিলতে থাকে, তার মাথায় কিছু ঢোকে
না। ওর শুধু নোট্স আর সাজেশন চাই। লেকচার শুনতে শুনতে হাঁপিয়ে ওঠে।
এম.এস. এর বাড়িতে সর্বাণীর গতিবিধি আপনজনের
মত। অধ্যাপকের বৃদ্ধা মাকে তোয়াজ করে বশ করেছে সর্বাণী। সপ্তাহে দুই দিন নয়,
যে কোন দিন — যে কোন সময় সর্বাণীর উপস্থিতি এখন এই বাড়ির দুটি প্রাণীর আনন্দের
উৎস। মাসিমা-মাসিমা করে আহ্লাদে আটখানা হয়ে সর্বাণী বৃদ্ধার সাথে মজার মজার কথা বলে।
নিঃসঙ্গ বৃদ্ধা সর্বাণীর সান্নিধ্যে আনন্দে উৎফুল্ল হন। আর এম.এস ? সুন্দরী নারীর ঘনিষ্ঠতা
তাকে জোগায় টাটকা যুবকের রক্ত। হাজার হোক অধ্যাপক সেন একজন জলজ্যান্ত পুরুষ মানুষ।
সর্বাণীর দৈহিক গতিবিধি, ঘন সান্নিধ্য আর নেচে যাওয়ার চোখের আহ্বানকে উপেক্ষা করার সামর্থ্য
তার নেই। তার চল্লিশটি বসন্তে সর্বাণীর মত কোন নারীর আহ্বান তিনি কোনদিন পাননি। তিনি
বিশ্বাস করতে শুরু করলেন যে সর্বাণী শুধুমাত্র তার ছাত্রীই নয় বরং তার জীবনের অনেক
কিছু। অতএব তিনি ইংরেজীর সম্ভাব্য প্রশ্নপত্র
তুলে দিলেন সর্বানীর হাতে। সেই সঙ্গে প্রয়োজনীয় নোট্স, সাজেশানস্। বললেন,
সর্বাণী যেন মাঝে মাঝে এসে দেখা করে যায়। পরীক্ষার মাত্র দু’তিনমাস বাকি। অধ্যাপক
সেন ভীষণ ব্যস্ত থাকবেন। সর্বাণী আশ্বস্ত করে, সে নিয়মিত আসবে।
ক্যালেন্ডারের পাতায় দিনগুলো উড়ে উড়ে যায়।
সর্বাণী এম.এস-এর বাড়ি এখন ভুলেও যায়না। ফোন করতে
পারেন না অধ্যাপক সেন। মর্যাদায় বাধে তার। মধ্য বয়সে তিনি যে নতুন জীবনের আলো দেখতে
পেয়েছিলেন, সেই আলো হঠাৎ নিভে যাওয়ায় চোখে অন্ধকার দেখেন। যে আগুন সর্বাণী
তার দেহমনে জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে সেই আগুনে তিলে তিলে পুড়তে লাগলেন। ভুলে যেতে লাগলেন
খাওয়া-দাওয়া কাজকর্ম- সবকিছু।
রাস্তায় একদিন হঠাৎ দেখতে পেয়েছিলেন সামনা
সামনি। সর্বাণী ওর তিন বান্ধবীর সাথে যেতে যেতে আড় চোখে দেখেছিল এম.এস.কে। অচেনার মত
পাশ কাটিয়ে চলে গিয়েছিল। তবে অধ্যাপক শুনতে ভুল করেননি সর্বাণীর শ্লেষমাখা অনুচ্চ কন্ঠস্বর
— এই রে, এম.এস ভাল্লুকটা ঘাড় না মট্কায়। চল কেটে পড়ি। তারপর খিলখিল হাসির
দমকা বাতাস। অধ্যাপক মানিক সেন থ’মেরে দাঁড়িয়ে ওদের যাওয়া দেখছিলেন অ-নে-ক ক্ষণ।
সেদিন ইংরেজির পরীক্ষা।
সর্বাণী আত্মবিশ্বাসে টইটম্বুর। এম.এস-এর
সাজেশান আর নোট তার মুখস্ত। পরীক্ষা হলে নিজের জায়গায় বসে একবার চারদিকটা দেখে নেয়।
জানালায় উঁকি মেরে কলেজের গন্ডিটাকে মনে মনে জরিপ করে। আর তক্ষুণি পরীক্ষার ঘন্টা বেজে
ওঠে।
সর্বাণী উত্তপত্রের খাতায় খুব সুন্দর করে
নিজের রোল নম্বর লেখার পর সাবজেক্ট-এর জায়গায়
ব্লক লেটারে যত্ন করে লেখে — ‘ইংলিশ’। ইংলিশ শব্দটা লেখার
সময় হাতটা একটু কেঁপে গিয়েছিল। সম্ভবতঃ এম.এস-এর নাম আর তার চেহারা হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়ায়।
ঠোঁটে মৃদু হাসি খেলে যায় ক্ষণিকের জন্য। বেরিয়ে আসে ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে একটি শব্দ
— বেচারা!
প্রশ্নপত্র হাতে এলে তিন বান্ধবীর উদ্দেশ্যে
কপালে হাত ঠেকায় সর্বাণী। তারপর প্রশ্নপত্র মেলে ধরে চোখের সামনে। কিন্তু এ কি
! প্রশ্নপত্রের প্রতিটি প্রশ্নের ওপর যখন তার
চোখ ধীরে ধীরে পিছলে যেতে লাগল, মুখের রঙও লাগল বদলাতে । আর... একসময় সর্বাণীর গোটা মুখটাই ফ্যাকাশে
হয়ে গেল...। অধ্যাপক মানিক সেনের দেওয়া নোট্স আর সাজেশান মতো একটি প্রশ্নও যে প্রশ্নপত্রে নেই !
––––––––––––––––––––––––––––
কালিনী, জানুয়ারী ২০১০
No comments:
Post a Comment