শরৎ এখন। স্টেশনের পাশ দিয়ে পূর্ব দিকের যে রাস্তাটি চলে গেছে দূরে, শ্মশানের
দিকে। শ্মশান পেরিয়ে কবরস্থান। শমিত ও রণিতা শেষ পর্যন্ত
এসে দাঁড়ায় কবরস্থানের পাশ দিয়ে সরু রাস্তাটির শেষ যেখানে। পাশ দিয়ে বয়ে গেছে
তিস্তার মজা খাল। বৃষ্টিতে ধুয়ে গেছে ধুলোবালি। পরিবেশ সতেজ। দুজন দুজনের চোখে তাকায়। রণিতা চোখ
নামিয়ে নেয়।
শমিতের সামনে রুণু তুলে ধরে সেই পুরনো ডায়েরীটি। শমিত ডায়েরীটি হাতে নিয়ে
নেড়েচেড়ে দেখতে থাকে, পৃষ্ঠা ওল্টায় না। শুধু পেছনের মলাটটি উল্টে গেলে দেখে ‘‘জন্মদিনে
বন্ধুকে, বন্ধুতার স্মারক, — শমিত।’’ শমিতের মনে পড়ে। শমিত পুলকিত
হয়। রণিতাকে দেখে, অবাক হয়।
অনেক দিনের চেনা বন্ধু দুজন। আড্ডা মেরেছে সব একসাথে, বন্ধুরা। তুই-তোকারি
সম্পর্ক। আজ যেন দুজনেই দুজনার কাছে কত নতুন ! এই বুঝি প্রেমের আশ্চর্য রসায়ন! শমিত আশ্চর্য
হয়ে দেখে, রণিতা যেন এক নীল আলোর ফুল। শমিতের মোবাইলে প্রিয় রিংটোনটি বেজে ওঠে। রণিতা তর্জ্জনী
তুলে দেখায়, খুব কাছে দুটি নতুন কবর। শমিত কলটা
রিসিভ করে না। বাজতে থাকে।
রণিতা বলে, শমি তোমার এই রিংটোনটা
শুনলে মনে হয়, শত শত যুদ্ধবাজ বীর সৈনিকের মৃতদেহ যেন সরে সরে যাচ্ছে চোখের সামনে দিয়ে
সমবেত বিউগল বাজনার মধ্য দিয়ে। যেন যুদ্ধ শেষ জীবনের, স্বগোতোক্তির মতো উচ্চারণ রণিতার।
অবাক হয় শমিত, বিষন্ন হয়। বদলে দিতে চায় রিংটোনটি।
রণিতা বলে, থাক্। এই বিষন্নতা হলুদ প্রজাপতির দুঃখের মতোই একান্ত। দুঃখই
তো একমাত্র যা মানুষকে নিভৃতে সঙ্গ দেয়।
নীলার সঙ্গে কোথায় যেন খুব মেলে রণিতার। জিনসের উপর বুটিকের হলুদ কুর্তা।
শমিতের খুব ইচ্ছে রণিতার পিঠের সেই জরুল চিহ্নটি
ছুঁয়ে দেয়।
রণিতার মোবাইল বেজে ওঠে। অফিসের
বস্। কাল ছুটতে হবে শিলিগুড়ি। শমিত তর্জনী
দিয়ে রণিতার জরুল চিহ্নটা ছুঁয়ে দেয়,
রণিতা চমকে ওঠে। কিছু বলে না। সোনালী
বিকেলের আলো রণিতার পিঠে। রণিতা মোবাইলে কথা বলতে থাকে। আদুরে ধমকের সুরে বলে — হচ্ছেটা কি ?
শমিত হাত সরায় না।
শমিত হাত সরিয়ে নেয়, রণিতা পেছন
ফিরে তাকায়। রণিতার ভালো লাগছিল একজন পুরুষের
নিরেট নির্ভার ছোঁয়া।
শমিত মনে মনে বলে, এই তো সেই অনাদিকালের মেয়ে, যাকে সে চায়। মোবাইলে কথা
ফুরোয় রণিতার।
সোনালী আলো ফুরিয়ে আসছে। হঠাৎ
একটি লোক পেছন থেকে হেঁকে ওঠে। রণিতা চমকে ওঠে।
— বাবু আপনারা কারা ? কোথা থেকে এসেছেন ? এখানে তো কেউ আসে না। আমাদের দিকে তাকায় সন্দিগ্ধ চোখে। লোকটি উত্তরের অপেক্ষা না করে খুব নির্লিপ্তভাবে
বলে, মেয়েমানুষের সঙ্গে ভর সন্ধ্যেবেলায় এখানে থাকবেন না। গতকালই এখানে এই দুটি কবর
দেওয়া হয়েছে। পাশের গায়ের দুটি জোয়ান ছেলে-মেয়ে।
শমিত বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করে, একই দিনে দুটি কবর!
— হ্যাঁ, প্রধান, আলী হোসেনের মেয়ে, আর রিক্সাওয়ালা রহমত চাচার কলেজে
পড়া ছেলে। লোকটির গলা আড়ষ্ঠ হয়ে আসে। শমিত কথা বাড়ায় না। লোকটি গরু নিয়ে হেঁটে এগিয়ে যায়।
চুপচাপ দুজন। নিবির সবুজের দিকে তাকিয়ে থাকে রণিতা। বাইকের উপর কাগজে মোড়া গোলাপের তোড়াটি শমিত রণিতাকে
দেয়। রণিতা খুব যতœ করে তা নেয়। বুকের কাছে নেয় ফুলের তোড়াটি।
গোলাপের কাঁটাগুলিতে হাত বোলায় রণিতা। তাজা গোলাপের তোড়াটি রণিতা দুটি কবরের মাঝখানে রেখে
আসে। শমিত রণিতার পেছনে এসে দাঁড়ায়।
— ভালোবাসা বুঝি এরকমই। শুধু দুঃখ দিতে জানে। সুখ অতি সামান্যই। মণিকাঞ্চন
বিদ্যুৎচ্ছটার মতো — রণিতা বলে।
— হ্যাঁ, ঠিক তাই।
— শমিত, তুমি কি আমার জীবনের
সবটুকু জানো ? দৃঢ়, আবেগহীন গলা রণিতার।
শমিতের দৃপ্ত উচ্চারণ — রণিতা । তুমি তো আমাকে চেন। জানো আমি দ্বিধাহীন, সপাট। আর তুমি যা জানতে
চাইছ, তা খুব সহজ করে বলছি — ‘ভার্জিনিটি ইজ
অ্যা স্টেট অব মাইন্ড’।
রণিতা নরম হয়। তার চোখ মুখে ফুটে ওঠে এক দীপ্ত বিভা। শমিত তা টের পায়। সন্ধ্যা
হয়নি এখনও। যদিও মেঘেরা বাড়ি ফিরছে। চাঁদ উঠছে আলতো করে।
দাগ, ২০১৩
No comments:
Post a Comment