শরতের কমললতা,
তোমাকে লেখা এই ব্যক্তিগত চিঠিটা নিয়ে আমি
প্রতিযোগিতায় নেমেছি বলে রাগ করবে ? আমি বিলক্ষণ জানি, এটা তুমি তোমার ঐ সাধের
ঝোলাটিতে কিছুতেই তুলে রাখবে না। কেননা এটা তো আর একান্ত ব্যক্তিগত রইল না। লক্ষ্মীটি,
বিশ্বাস কর, এটা নিছকই মজা।
সত্যি বলতে কি কুমু, আমাদের প্রেমপত্রগুলো
তো গড় হিসেবে ঠিক প্রেমপত্র নয়— এত আটপৌরে,
এত অনাড়ম্বর, তাই বেশ কিছুটা মিষ্টি-মিথ্যে আর কিছুটা গোলাপী-নীল কল্পনার
আবীর মিশিয়ে চিঠিটা লিখছি। দেখো মিলিয়ে— উহু, মুখ ফুলিয়ে ‘ঢং’ বলবে না কিন্তু। ঐ
মনো-সিলেবিলিক শব্দটা শুনলেই আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়, তা তো তুমি জানোই প্রিয়ে!
শোনো একটা কথা মনে পড়ল হঠাৎ করে— আচ্ছা, সবকিছুই কি সংজ্ঞায়িত।
নিক্তি-মাপা হতেই হবে। যেমন ধরো অষ্টমীর সকালে যেমন শাড়ি পড়তেই হয়, প্রেমপত্রও কি ভাবরসে
চুপচুপে হতেই হবে। আচ্ছা, কেউ যদি রবীন্দ্রসঙ্গীত না শোনে, জীবনানন্দ না পড়ে,
২৫শে বৈশাখেও দিব্যি প্যান্ট-শার্ট পরে চালিয়ে দেয়, তার কি প্রেমের মাঠে
খেলবার অধিকার নেই! আজব কথা, কিন্তু কুমু আমি তো জানি আরোপিত জিনিসে তোমার কি আপত্তি। ঠিক
যে কারণে তুমি জয়া ভাদুরীতে মুগ্ধ ছিলে, অজয় জাদেজাকে ভালোবাসতে, অজয় দেবগণকে ভালোবাসো,
ঠিক সেজন্যই তোমায় আমার এত রাশি রাশি ভালো লাগে — সাবলীল, নির্ভার, অনাড়ম্বর অথচ বেঁকিয়ে-চুরিয়ে
কথা বলার জড়তা থেকে হাজার হাত দূরে। কমল, তোমার সাথে দেখা হবার পর থেকেই আমি ETv-র
টেলিফিল্ম দেখা ছেড়ে দিয়েছি— উফ্, সাধারণ বিষয়গুলোকে কি জটিল করে তোলে অনর্থক— খবরটা শুনেই এখন চূনী-পান্নাতে
চলে যাই! অবশ্য এক বছর পর থেকে ঠিক সাড়ে ন’টায় ঘরের সব আলো নিভে যাবে (আগামী মাঘের মধ্যে
আমাদের বিয়েটা হয়ে যাবে না খুকু!), থাকব আমি-ই তুমি-ই আর, আর . . . . সাঁঝবাতির
রূপকথারা। শোনো এবার কিন্তু সুর টেনে ‘কি. . . ই অসভ্য!’ বলবে না বলে দিচ্ছি,
আমি জানি মাঝে-সাঝে একটু-আধটু অসভ্যতা তোমার খারাপ লাগে না! আচ্ছা সরি! সরি! ওক্কে
বাবা !!
তুমি চলে যাবার পর থেকে টিউটোরিয়াল-টা একাই
চালাচ্ছি, তবে খুব শিগগিরি-ই একজন সায়েন্সের টিচার নিতে হবে। কে জানে,সেই অঙ্কের দিদিমণিটা
আবার কেমন হয় ? ‘ম্যায় হু না’-র সুস্মিতা অবধি সামলে নিতে পারব,
তবে ‘মেরা নাম জোকার’-এর সিমি গারেওয়ালের মত কেউ এলে কি করব গ্যারান্টি
দিতে পারছি না কিন্তু !
তোমার পিতৃদেবের তাকানো-টাকানো গুলো একটু
কমনীয় আর নমনীয় হয়েছে বলে মনে হচ্ছে, আসলে বড় মেয়ে দিদিমণি হয়ে দূর ডুয়ার্সে চলে
গেছে বলেই বোধহয়। সেজন্যই মনে হয় কমল মিত্র থেকে পাহাড়ী সান্যাল আপাত ট্রান্সফর্মেশন!
অবশ্য নিজের চাকরীরতা কন্যেরতœটিকে কেই বা সেমি বেকার ইতিহাসের টিউটর-এর সাথে বিয়ে দেবার দুঃসাহস
রাখে। কি জ্বালা বলতো, সবাইকে কি SSC-PSC পেতেই হবে ? RICE এর সমিত রায় পেয়েছে? বিখ্যাত সত্যদা-মিলনদারা পায় ? — সেরকম ধরো আমিও পেলাম
না, তো ? হেসো না, সিরিয়াস; তাতে কি তোমার সামাজিক মর্যাদা এতটুকু কমে যাবে ? কি জানি !
গত
পরশু দিন আবার তোমার প্রিয় ‘হাম দিল দে চুকে সনম’ দেখলাম— ট্রেনের ভেতরের সেই দৃশ্যে অজয়-ঐশ্বর্যের অভিনয় দেখে তুমি কেঁদে ফেলেছিলে
মনে আছে ? মাঝে মাঝে ভাবি, প্রেম মানে তো একটা টিউনিং— ঠিকঠাক Centre
এর সাথে কাঁটা ম্যাচ করলেই আনন্দ, নাহলে পুরোটাই মাথা ধরানো ঘ্যাস-ঘ্যাস এবং
বরবাদ। তোমার সাথে পরিচয়ের আগে ভাবতাম এমন
কাউকে কি পাওয়া যাবে যার সাথে আমার নিজের
ভালোলাগা-মন্দলাগার সরল দোলগতিটা মিলে যায় এবং তার জন্য কোনো বাহ্যিক প্রকাশের
প্রয়োজন পড়ে না। কি আশ্চর্য, যখন দেখলাম উৎপল দত্ত বা ওমপ্রকাশের অভিনয় দেখে আমি যতটা আনন্দ
পাচ্ছি, সলমন খানের খালি গা দেখে যতটা ঘেন্না লাগছে, যেশু দাস- হরিহরনের
গান শুনে যতটা মুগ্ধ হচ্ছি, তিলোত্তমার লেখা পড়ে যতটা আশ্চর্য হচ্ছি— প্রতিটি ক্ষেত্রেই,
তোমার উপস্থিতিটা, তোমার কাছে থাকাটা আমাকে আমার ব্যক্তিগত আনন্দিত-বিরক্ত-মুগ্ধ
বা আশ্চর্যান্বিত হওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বাধা দিচ্ছে না; তখন বুঝলাম ইহাকেই
বোধহয় প্রেম বলিয়া জানে বিশ্ব চরাচর! দুটি আলাদা আলাদা মানুষের নিভৃততম মুহূর্তের,
একান্ত নিজস্ব অনুভূতির সাবলীল মিলে যাওয়াটাকেই তো প্রেম বলব, কুমু ?
তুমি কেন এত ভালো, এত নরম কুমু ?
কেন এত সংবেদী, এত না বলা কথা কি করে বুঝে যাও বলো তো ? এজন্যই না তোমার ওপর
মাঝে মাঝে আমার রাগ হয়, এত ভালো হলে হয় ? এবারে তিস্তা ক্যানেলের ধারে তোমার পাশে বসে
থাকার সময় কি জানি একটা কষ্ট গলার মাঝে কেমন যেন দলা পাকিয়ে উঠছিল; আমি জানি না কুমু কেন,
বিলিভ মি, আমি জানি না, — অথচ কোনো কারণ ছিল না। পরে ভেবে দেখলাম—
আমি ভয় পাচ্ছি তোমার স্থিতিশীলতাটাকে, আমি ভয় পাচ্ছি আমি মুখে যেই Careless-Casual ভাবটা দেখাই সেটা যে সত্যি নয় সেই আশঙ্কায়, আমি ভয় পাচ্ছি তোমাকে
না পাওয়ার একটা অজানা আশঙ্কায়। তার পরে আমি কাঁদলাম কুমু, অনেকক্ষণ ধরে কাঁদলাম,
বহুদিন পর কাঁদলাম, জীবনে প্রথমবার কাঁদলাম কারো পবিত্র বিশ্বাসের ওপর আস্থা রাখতে
না পারার আমার মানসিক দুর্বলতার ওপর ক্ষোভে। ওহো ! দ্যাখো আবার আর্ট ফিল্মের চিত্রনাট্য
শুরু করেছি! শোনো না, তোমার ঐ যে পাকা বান্ধবীটি আছে না— হ্যাঁ হ্যাঁ,
উষসী ( ওটা আসলে উনুন + সাঁড়াশীর যোগফল!!) — এত মাতব্বর না,
কি বলব ? টিপিক্যাল SUCI করা মেয়েদের চেহারা আর জুন মালিয়ার মত পেঁচিয়ে কথা বলা— অসহ্য ! সেদিন আমায়
বলছে, ‘সুকু দা, তুমি নাকি ওকে ফোন-টোন
ক’রছ না ? নিয়মিত ফোন করবে।’ — ভাবো ! আরে,
মেনে নিচ্ছি ও আমাদের অনেক চিঠি চালাচালি করেছে, দু’একবার ওর পিসির খালি
বাড়ি ম্যানেজ করে আমাদের প্রেম-ট্রেমও করতে দিয়েছে, তাই বলে সবসময় গার্জেনগিরি
? তোমার ঐ পেয়ারের বান্ধবীটিকে একটু কম আস্কারা দিও; সেদিন আবার দেখলাম
ঐ কবি-কবি চেহারার বুম্বার বাইকের পেছনে, যত্তোসব!
‘ডুয়ার্স উৎসব’ কেমন লাগল —
রাত জেগে ভাওয়াইয়া শুনলে নিশ্চয়ই ? তোমার সেতারটা এবার এলে নিয়ে যাবে ?
সরস্বতী পূজোয় আসবে তো সোনা ? আসতে তো হবেই — আমাদের প্রেমের ঠিক দুটি বছর বয়স যে হবে সেদিন।
এবারেও ঐ ময়ূরকন্ঠী নীল শাড়িটি পড়বে তো, যেটায় তোমায় প্রথম দেখেছিলাম। দ্যাখো,
কিরকম ক্যাবলা ক্যাবলা আঠারো বছরের প্রেমপত্রের মত লিখছি ! তোমাদের স্কুলে লিপস্টিক
বিতর্কের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া কেমন চলছে — এই শীতে চপ-মুড়ির সাথে ক’দিন কমনরুমে ভালোই
জমবে না ?
চিঠিটা পড়া হলেই বাঁ হাতে চশমা খুলে ডান হাতে
আঁচল দিয়ে কাচটা মুছে বুকের ওপর পড়ে থাকা, পড়তে থাকা ‘দেশ’টা বালিশের এক পাশে
রেখে আলগোছে ঘুমিয়ে পোড়ো লক্ষ্মীটি, ‘পাকিজা’র মীনাকুমারীর মতো।
একটু ফোলা চোখে— ধরা গলায় না তোমায় ‘১৯৪২’-র মনীষা কৈরালার মত fresh অথচ appealing
দেখায়!
গুণে গুণে ছ’টা ইয়ে, মানে ঐ ইয়ে রইলো তোমার
জন্যে অঙ্কের দিদিমণি!!
শুধু
ভালো থেকো —
ইতি
শ্রীকান্ত
০৬-০২-০৫
বিবর, এপ্রিল
২০০৫। বিবর আয়োজিত প্রেমপত্র লেখা প্রতিযোগিতায় তৃতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত চিঠি। পুরস্কার মূল্য:পাঁচশত টাকা।
No comments:
Post a Comment