‘‘হয়ত কথাটা জানাতে দেরি করে ফেলেছি,
কোনটা সঠিক সময় ছিল সেটা আজও বুঝে উঠতে পারি নি। কিন্তু তুমি বিশ্বাস কর,
সেই সব মুহূর্তগুলিতে যখন তুমি আমার সঙ্গে ছিলে . . . ., ’’ পঁয়ত্রিশবার এই ভাবেই
শুরু করে ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছিলাম। শুধু মাত্র একটা ভয়, যেটা সবাইকে বুঝিয়ে
বলা যায় না, আবার বলার দরকারও হয় না।
এই একুশ-বাইশ বছরের জীবনে হয়ত একুশ-বাইশবার
প্রেমে পড়েছি, কোনোটা এক মিনিটের জন্য তো কোনোটা ... ..., কিন্তু কোনো সাহসী
পদক্ষেপ নেওয়ার আগে একুশ হাজার বার ভেবে ফেলেছিলাম। ফল ... ? ঐ পঁয়ত্রিশবার লিখে
ছিঁড়ে ফেলা— ‘‘হয়ত কথাটা জানাতে দেরী করে ফেলেছি ... ’’ তাই এটা নিশ্চিত যে, প্রেমে বেশী ভাবনা
চিন্তা প্রেমের স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। তাও কী সম্ভব ? প্রেম উইদাউট চিন্তা
ভাবনা ? প্রশ্নটাই অর্থহীন। যেটা প্রেমের অন্যতম অনুভূতির একটা,
তাকে বাদ দিয়ে অসম্ভব। আর এই ক্ষেত্রে চিন্তা ভাবনা যে সব বস্তুর চারপাশে ঘোরাফেরা
করে তা হলপ করে বলা যায় প্রেমের স্থান-কাল-পাত্র; যেগুলো প্রেমের ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর। এর কোন অংশে কম নয়।
আর আমাদের মতো মফস্বল এলাকাতে তো এগুলোই সব সুবিধা-অসুবিধার প্রাণকেন্দ্র। তিনটির মধ্যে
একটি বিরূপ হলে প্রেমের খাতায় গোল্লা ছাড়া উপায় নেই। আর আমার ক্ষেত্রে ঐ তিনটে বস্তু
? ঘটনার বর্ণনা করছি :—
এক ॥
তখনো আমার প্রেমটা ঠিক প্রেমের স্থানে নয়, বরং মন দেয়া-নেয়ার
প্রাক মুহূর্তে, হঠাৎ একদিন রাস্তায় দেখা। দুজনের নিরিবিলি রাস্তা দিয়ে হেঁটে
চলেছি, উফ্ কী অ্যাডভেঞ্চার, মনে তখন কেবল একটা
গানই উঁকি দিচ্ছিল— ‘‘এই পথ যদি না শেষ হয় ...’’। অনেক সাহস করে যেই
মনের কথাটা বলতে শুরু করব অমনি সে বলে উঠল— ‘‘ওরে বাবা ! অসীম কাকু,
এদিকেই আসছে, তুমি বাঁ-দিকের রাস্তায় যাও। আমি... আমি সোজা যাচ্ছি,
পরশু দেখা হবে, আরে যাও বলছি।’’ ব্যস— মনে জেগে ওঠা ‘‘এই পথ যদি না শেষ হয়’’
তখন ‘‘কী আশায় বাঁধি খেলা ঘর ...’’।
দ্বিতীয় বস্তু ‘কাল’ অর্থাৎ সময়। আমার ও
আমার ক’টা পরিচিত বন্ধুদের প্রায় একই অবস্থা,— আমাদের ‘কালের ঘরেই কাল’। কারণ সব সময়,
সময় মতো বা সময় করে দেখা-সাক্ষাৎ এমন কী মাঝে মধ্যে একটু চোখের দেখা করে ওঠাও সম্ভব
হয় ওঠে না। এই শুনে এক দূরের বন্ধুর এক ভয়ঙ্কর উপদেশ— ‘‘মাই ডিয়ার ফ্রেন্ড,
আউট অব সাইট, আউট অব মাইন্ড। তাই নিয়মিত দেখা-সাক্ষাৎটা চালিয়ে যা,
নইলে আমি চাই না তোর অবস্থাটা আমার মতো হোক !’’ ব্যস্, ঐ কথা শুনে কোন নতুন
প্রেমে পড়া প্রেমিকের মন স্থির থাকে। তখন প্রেমিকের কাছে কিছু সময় চেয়ে বুঝতে
পেরেছিলাম যে, আমাদের মতো ছা-পোষা বাঙালী ঘরের মেয়েদের প্রেমের জন্য সময় বের
করা বা ছোট্ট কথায় ম্যানেজ করা ঠিক আমার জানা এক স্কুল শিক্ষকের বাজার যাবার অসুবিধার
মতো। দু’দিকের অবস্থা প্রায় এক, প্রথমটি—
‘‘কখন সম্ভব বলোতো ? টিউশন থেকে ফেরার সময় একগাদা বন্ধু-বান্ধবী, বিকেলে গানের দিদিমণি,
উপায় কই .. ’’। আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রে স্যারের চারিদিকে টিউশন নিতে দলে দলে
যোগ দেওয়া ছাত্রদের পাহারা। তাই বাজারে যাবার সময় কই ? অতএব সময় ও উপায় দুই
বস্তু একসাথে আসতে চায় না।
এবার আসি তৃতীয় বা শেষ বস্তুর কথায় —
‘পাত্র’। কেন জানি অনেক আগে থেকেই এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে
যে, আমার দ্বারা প্রেম
করা সম্ভব নয়। প্রেম করার মতো জাঁদরেল, সাহসী, অতি রোমান্টিক,
বানিয়ে বানিয়ে কিছু বলে প্রেমিকার কাছে বিশেষ স্থান করে নেবার মতো পাত্র আমি কোন
দিনই নই। আর ‘প্রেমের কথা ফোটার আগেই রটে’— এই কথা মনে করেই তো উৎসাহে অর্ধেক ভাঁটা চলে আসে। তাই প্রেম
করার মতো পাত্র ও মানসিক প্রস্তুতি ছাড়া প্রেমের জলে থৈ পাওয়া চিন্তার বিষয় !
খুব ভালো করে প্রত্যক্ষ করা দুটো ঘটনা দিয়েই
যবনিকা টানার চেষ্টা করব। — সেবার কলকাতা গিয়ে
প্রতিবারের মতো প্রেমের অন্যতম পীঠস্থান ‘ভিক্টোরিয়া’য় বেড়াতে গেছি। এদিক
ওদিকে ছড়িয়ে থাকা অগুণতির মধ্যে কেন জানি চোখ দুটো বিশেষ একজোড়া প্রেমিক-প্রেমিকার
সামনে গিয়ে আটকে গেল। কারও মুখ দেখা যাচ্ছে না। একটা ওড়না দিয়ে দুজনেরই মুখ ঢাকা,
একটা গাছে হেলান দিয়ে দুজনে খুব কাছাকাছি বসে। প্রায় আধঘন্টা ধরে পর্যবেক্ষণ করে
মনে সত্যিই সন্দেহ হয়েছিল যে তারা আদৌ বেঁচে আছে কিনা ! কি আশ্চর্য
আধঘন্টা ধরে একই ভঙ্গিতে, একটুও মুভমেন্ট নেই। প্রথমবার বুঝেছিলাম ‘প্রেম মৃত্যু সম’।
শেষ ঘটনা — আমার এক খুব ভালো বন্ধু
একই সাথে উচ্চমাধ্যমিক দেব। খুব গল্প করতে ভালোবাসে, কিন্তু একটা শর্ত,
গল্পে যেন প্রেম না আসে। স্বভাববতই প্রেম ছাড়া গল্প সে বয়সে কজনারই বা ভালো লাগে ? তবু ওকে সঙ্গে রাখতে
গেলে প্রেমকে বাদ দিতে হতো। বুঝতাম না প্রেম
ও সেই বন্ধুর সহাবস্থান হয় না কেন ! অন্যরা সবাই মিলে অনেক তদন্ত করেও এর কূল পাইনি।
ঠিক এক বছর পর, অনেক দিন দেখা-সাক্ষাৎ নেই
সেই জন্য তার বাড়ি ফোন করি। সেই দিন আমার জীবনের প্রথম ট্র্যাজেডি —
‘‘ তুমি জানো না, কান্তি আÍহত্যা করেছে প্রায় দু’মাস হল।’’ আজও বুঝে উঠতে পারিনি
কী ভাবে সম্ভব, যে প্রেমকে পাত্তা পর্যন্ত দিতে চায়নি সেই আবার প্রেমের জন্য
সবথেকে মারাÍক পদক্ষেপ নিল। দ্বিতীয়বার
বুঝতে পারলাম ‘মৃত্যু সম প্রেম’।
পৃথিবীর
সব প্রেমী সুখী হউক।
––––––––––––––––––––––
বিবর, এপ্রিল ২০০৫
No comments:
Post a Comment