July 28, 2014

প্রবন্ধ : ঠাকুর পঞ্চানন বর্মণ, ক্ষত্রিয়ায়ন আন্দোলন এবং বর্তমান রাজবংশী সমাজ / পার্থ সেন

ষোড়শ শতকে মহারাজ বিশ্ব সিংহ কামতা-কোচবিহার রাজ্য স্থাপন করেন। দরং রাজবংশাবলী, আসাম বুরুঞ্জিতে কোচরাজাদের রাজবংশী হিসাবে উল্লেখ করা হয়নি। ১৯১৪ খ্রীষ্টাব্দে ঘনশ্যাম দলাই তাঁর কাব্যগ্রন্থে বিশ্বসিংহকে প্রথম ক্ষত্রিয় বংশজাত বলে উল্লেখ করেন। কামতা-কোচবিহার রাজ্যের জনগোষ্ঠী কোচ-মেচ, কাছাড়ি ইত্যাদি নামে পরিচিত ছিল। মহারাজা বিশ্ব সিংহ রাজ্য স্থাপন করার পর কালীচন্দ্র ভট্টাচার্য নামক জনৈক ব্রাহ্মণের নিকট হিন্দু শাস্ত্রমতে শৈবধর্মে দীক্ষিত হন। বিশ্ব সিংহ কনৌজ, কাশী প্রমুখ স্থান থেকে ব্রাহ্মদের কোচবিহার রাজ্যে আসেন। মহারাজা নরনারায়ণের সময় সিদ্ধান্তবাগীশ বাংলার রঘুনন্দনের মত ১৮টি স্মৃতিশাস্ত্র রচনা করেন। তাঁরই নির্দেশে কামতা-কোচবিহার রাজ্যে বর্ণাশ্রম প্রথা চালু হয়। স্থানীয় জনজাতি ব্রাহ্মণ্যধর্মের এই আধিপত্য মেনে নেয় নি। তাই ১৫৪৬ খ্রীষ্টাব্দে মহারাজা নরনারায়ণ তাঁর রাজ্যে কাছাড়ি, মেচ কোচ জনগোষ্ঠীকে আদিম উপজাতি পদ্ধতি অনুসারে শিবের উপাসনা করার অধিকার দেন। মহারাজা নরনারায়ণ নিজেও ঐ পদ্ধতিতে শিবের আরাধনা করেন। এই ভাবে মহারাজা নারনারায়ণ ব্রাহ্মণ্য ধর্মের সাথে ইন্দো-মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় বিরোধের মীমাংসা করেন। মহারাজা নরনারায়ণের সময় শঙ্করদেব প্রবর্তিত বৈষ্ণবধর্ম নবস্থাপিত কামতা-কোচবিহার রাজ্যে সামাজিক স্থিতিশীলতা আনতে সক্ষম হয়। আবার কোচবিহার রাজ্যে সংস্কৃত্যায়নের প্রক্রিয়া বৈষ্ণব ধর্মের মধ্য দিয়েই পূর্ণ হয়।

অষ্টাদশ শতাব্দীর সাতের দশকে যখন কোচবিহার রাজ্য ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানীর করদ রাজ্যে পরিণত হয় তখন থেকে  প্রশাসনিক কার্যে দক্ষিণবঙ্গের উচ্চবর্ণের লোক নিযুক্ত হতে থাকে। অত্যধিক হারে রাজস্ব আদায়ের তাগিদে কোম্পানী ইজারাদারী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করেন। ইজারাদারী ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে বহিরাগতরাই ইজারাদার হিসাবে নিয়োজিত হয়। ইজারাদের অত্যাচারে স্থানীয় কুচবিহারী জোতদাররা জমিচ্যুত হতে থাকে। স্থানীয় জোতদারদের জমি বেনামে ইজারাদারদের দখলে চলে যায়। শুরু হয় বহিরাগত  বনাম কুচবিহারী দ্বন্দ্ব। অবস্থা সামাল দিতে কোম্পানী ইজারাদারী ব্যবস্থা তুলে দিয়ে স্থানীয় জোতদারদের হাতে জমি তুলে দেয়। রেল যোগাযোগ এবং কৃষির বাণিজ্যীকীকরণ ইত্যাদি কারণে বিংশ শতাব্দীতে স্থানীয় জোতদাররা জমি ধরে রাখতে পারল না। তাই ইংরেজ সরকার জোতদারদের সাথে ভূমি রাজস্ব বন্দোবন্তের পরিবর্তে সরাসরি রায়তদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে স্থানীয় জোতদারদের পক্ষ থেকে পুরানো ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা বহাল রাখার জন্য সরকারের কাছে স্মারক লিপি দেন  খান চৌধুরী আমানতুল্লা। আমানতুল্লা ১৯৩৪ খ্রীষ্টাব্দে স্মারকলিপিতে বলেন জোতদারী ব্যবস্থার ফলে জোতদারদের মধ্য থেকে শিক্ষাদীক্ষায় অগ্রগণ্য একটি মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয়েছিল। ফলে স্থানীয় জোতদারী ব্যবস্থাকে বহাল রাখার জন্য তিনি সুপারিশ করেন।

বহিরাগত উচ্চবর্ণ সম্প্রদায় স্থানীয় কোচ সম্প্রদায়কে নীচু চোখে দেখত, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। কোচবিহার রাজ্যের প্রশাসনে ইংরেজ রেসিডেন্ট এবং পার্শ্ববর্তী  জেলা থেকে উচ্চবর্ণ সম্প্রদায়ের দখলে ছিল। ঠাকুর পঞ্চানন বর্মণ এম.এ.বি.এল পাশ করার পর কোচবিহার রাজ্যের সরকারী চাকুরীর জন্য আবেদন করলে ইংরেজ রেসিডেন্ট ঐ আবেদন খারিজ করে দেন। রঙপুরে যখন পঞ্চানন বর্মণ ওকালতি করতেন তখন একদিন কোর্টে যাবার সময় ভুল করে জনৈক মৈত্র মহাশয়ের ডোগা পড়ে চলে যান। এজলাস থেকে ফিরে এসে টোগা ফেরৎ দিতে গেলে মৈত্র মহাশয় বলে ‘আমি  রাজবংশীর মাথায় দেওয়া টোগা ব্যবহার করতে ঘৃণা বোধ করি। ‘‘উল্লেখ্য রঙপুর কোর্টে পঞ্চানন বর্মনের ওকালতিতে ব্যাপক সাফল্য উচ্চবর্ণ সম্প্রদায়ের উকিলরা হিংসার চোখেই দেখেছিল। পাগড়ী পরার জন্য পঞ্চানন বর্মণকে কোচবিহার রাজ্য থেকে বহিষ্কার পর্যন্ত করা হয়েছিল। কারণ কোচবিহার রাজ্যে রাজা ব্যতীত অপর কারুর পাগড়ী পরার অধিকার ছিল না। ১৯১৬-২০ সাল পর্যন্ত ভিক্টোরিয়া মহাবিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসে দুটো খাওয়ার ঘর ছিল। সব ছাত্রই যে কোন ঘরে বসে একসাথে খেতে পারত। তারপর ছাত্রাবাসের সুপারিনটেনডেন্ট নির্দেশ জারী করলেন যে একটি ঘরে ব্রাহ্মণ ছাত্ররা আহার করবে  অপর ঘরে কায়স্থ ছাত্ররা আহার করবে। অন্যান্য সম্প্রদায়ের ছাত্রদের জন্য স্বতন্ত্র ঘর নির্মাণ করা হবে। উপেন্দ্রনাথ বর্মণ প্রতিবাদ করায় কলেজের অধ্যক্ষ পুরানো ব্যবস্থা বহাল রাখতে বাধ্য হন। শুধু কোচবিহার জেলাতেই নয় রাজশাহী কলেজেও রাজবংশী ছাত্রদের ছাত্রাবাসের আহার ঘরে খেতে দেওয়া হত না। নীচু জাতের ছেলেদেরকে নিজেদের বাসন ধুতে হত। সর্ব ভারতীয় বোড়ো ভাষা সমিতির সভাপতিও বলেছেন আলিপুরদুয়ার উচ্চ বিদ্যালয়ে মেচ ছাত্ররা একই ব্যবহার পেত।

শুধুমাত্র রাজবংশী বা বোড়ো সম্প্রদায়ের ছাত্ররাই বর্ণ হিন্দুদের কাছ থেকে দুর্ব্যবহার পেত না। এমনকি রাজবংশী সম্পন্ন জোতদার শ্রেণী বর্ণহিন্দু জমিদারদের কাছ থেকে ভাল ব্যবহার পেত না। উচ্চ শিক্ষিত হলেও রাজবংশী ছাত্ররা ভালো সরকারী চাকুরী থেকে বঞ্চিত হত। এই বঞ্চনাই রাজবংশী সম্প্রদায়ের মধ্যে এক প্রকার স্বাভিমান সৃষ্টি করে এবং নিজ গোষ্ঠীকে উচ্চবর্ণে উত্তরণের প্রয়াস নেয়। ইতিমধ্যে ব্রিটিশ সরকার জনগণনার কাজ শুরু করলে রাজবংশী সম্প্রদায় মনে করে সরকারের জনগণনার আসল উদ্দেশ্য হল যে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সামাজিক অবস্থান নির্ণয় করা এবং সেই হিসাবে সরকারী নীতি নির্দ্ধারণ করা। তাই এই সময় থেকে নিুবর্ণের অন্তর্ভূক্ত মানুষ জনগণনার সময় নিজেদেরকে উচ্চবর্ণভূক্ত বলে উল্লেখ করানোর উদ্যোগ নেয়। এই মত ওমেলীর। তবে রাজবংশী সম্প্রদায়ের ক্ষত্রিয় বংশজাত হিসাবে পরিচিত হবার তাগিদ মূলত ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিরোধিতা এবং ইংরেজ সরকারের ঔপনিবেশিক নীতি থেকেই সৃষ্টি হয়েছিল। এ.কে. রায়ের ভাষায় ‘....the origin of Kshatriya movement could be located in the hatred and ill treatment received by the community at the hands of the upper caste of the Hidu Society, but the immediate cause of the movement was census of India, 1891.’’ অপর দিকে ১৮৫০ সালের পর থেকেই ঔপনিবেশিক সরকার ভারতের বিভিন্ন জনগোষ্ঠী, নৃতত্ত্ব, জাতিভেদ প্রথা, উপজাতি ইত্যাদি সমৃদ্ধ তথ্য সংগ্রহ করতে শুরু ক করা। কারণ ১৮৫ খ্রীষ্টাব্দের পর থেকেই ব্রিটিশ নীতি হয় ভারতবর্ষকে বিভিন্ন ধর্ম, বর্ণ এবং সম্প্রদায়ে বিভক্ত  রাখা। ১৯০১ খ্রীষ্টাব্দে  থেকে জনগণনায় কোচরা নিজেদের রাজবংশী বলে উল্লেখ করতে শুরু করে। ১৯১১ এবং ১৯২১ খ্রীস্টাব্দে পলিয়া সম্প্রদায়ও নিজেদের রাজবংশী সম্প্রদায়ভূক্ত বলে নথিভূক্ত করে।

রঙপুরের জাগের গানের রচয়িতা রতিরাম দাস নিজেকে ক্ষত্রিয় বংশজাত বলে উল্লেখ করেন এবং পরশুরামের ভয়েই ক্ষত্রিয়রা উত্তরবঙ্গে পালিয়ে আসে। তাই রতিরাম দাস উত্তরবঙ্গের ক্ষত্রিয়দের ভঙ্গ ক্ষত্রিয় বলে উল্লেখ করে দেন। রাজবংশী ক্ষত্রিয় সমাজ কৃর্তৃক ইন্ডিয়ান স্টেটুটরি কমিটির কাছে প্রদত্ত এক স্মারকলিপিতে উল্লেখ করা হয় যে রাজবংশী ক্ষত্রিয়রা মুসলিম আক্রমণের পূর্বে কামতা বিহারে রাজত্ব করত। অক্ষত্রিয়দের ষড়যন্ত্রেই রাজবংশী ক্ষত্রিয়রা মুসলিম  শক্তির কাছে পরাস্ত হয়। পৌরাণিক কাহিনী যাই হোক না কেন রঙপুরের রাজবংশী জমিদার হরমোহন রায় প্রথম রঙপুরের ব্রাত্য ক্ষত্রিয় জাতির উন্নতি বিধায়নী সভা নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। শিক্ষা-দীক্ষায় অগ্রগণ্য রাজবংশীরাই এই সংগঠনের সদস্য ছিলেন। কিন্তু ১৯১০ খ্রীষ্টাব্দে ঠাকুর পঞ্চানন বর্মণ রঙপুরে রাজবংশী সমাজের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন এবং রাজনৈতিক ভাবাদর্শ সংগঠিত করার উদ্দেশ্যে ক্ষত্রিয় সমিতি গঠন করেন। ক্ষত্রিয় সমিতি প্রথম দিকে যে রাজবংশী ক্ষত্রিয় সমাজের উন্নয়নমূলক কাজের মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রেখেছিল তা বোঝা যায় ঠাকুর পঞ্চানন বর্মণ কর্তৃক ১৯২৪ সালের ১৫ই জুনের রঙপুরের ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্টেরটকে লিখিত এক পত্র থেকে। ঐ পত্রে উল্লেখ করা হয়, ‘‘It takes up questions of public interest which concern the all round welfare of the Kshtriya Community and are not concerned with the welfare of the country’’ ১৯২০  সাল থেকে ক্ষত্রিয় সমিতির মুখপত্র ‘ক্ষত্রিয়’ প্রকাশিত হতে থাকে। মূলতঃ ক্ষত্রিয় আদর্শ, আচার-আচরণ মেনে চলতে নির্দেশ দেওয়া হয় রাজবংশীদের। ১৯১২ খ্রীষ্টাব্দের মাঘ মাসে ক্ষত্রিয় সমিতির উদ্যোগে জলপাইগুড়ি জেলায় দেবীগঞ্জে করতোয়া নদীর তীরে নবদ্বীপ, মিথিলা, কামরূপ থেকে ব্রাহ্মণদের এনে হিন্দুশাস্ত্র মতে যজ্ঞে হাজার হাজার রাজবংশীকে উপবীত ধারণ করানো হয়।

এখন থেকে রাজবংশী ক্ষত্রিয়দের বিভিন্ন ধর্ম্মীয়  সামাজিক অনুষ্ঠানে ব্রাহ্মণ পুরোহিত দিয়ে পূজা-আর্চা ও যজ্ঞ করার নির্দেশ দেওয়া হয়। অর্থাৎ পুরানো রাজবংশী পুরোহিত অধিকারীদের স্থান ব্রাহ্মণ পুরোহিতরা দখল করে। মৃত্যুর পর তিরিশ দিনের বদলে ১২দিন অশৌচ পালনের বিধান দেওয়া হয়। শক্তির প্রতিমূর্তিস্বরূপ পঞ্চানন বর্মণ চন্ডীর উপাসনাকে গ্রহণ করেন। চন্ডীদেবীর উপাসনা করতে কোন ব্রাহ্মণ পুরোহিতের প্রয়োজন হত না। মহিলাদের পর্দা প্রথা গ্রহণ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। পূর্বেকার মত মহিলাদের অবাধ মেলামেশা বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়। নিঃসন্দেহে ক্ষত্রিয় সমিতির নির্দেশাবলীর জন্য রাজবংশী মহিলাদের স্বাধীনতা অনেকটা ক্ষুন্ন হয়।

সামাজিক সংস্কারের পাশাপাশি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় পঞ্চানন বর্মণ আসাম এবং বাংলার রাজবংশী যুবকদের ইংরেজ সামরিক বাহিনীতে যোগদানের নির্দেশ দেন। ঠাকুর পঞ্চানন বর্মণের নেতৃত্বে চারশো রাজবংশী যুবক সামরিক বাহিনীতে যোগ দেয়। ক্ষত্রিয় সমিতির উদ্দেশ্য ছিল রাজবংশী যুবকগণ সামরিক বাহিনীতে যোগ দিয়ে একদিকে যেমন অর্থ উপার্জন করার সুযোগ পাবে তেমনি অপরদিকে সরকারী চাকুরীতে নিযুক্ত হবার সুযোগ পাবে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেনকে সহায়তা করার জন্য পঞ্চানন বর্মণ রায়সাহেব খেতাব অর্জন করেন এবং তাঁকে মেম্বার অব ব্রিটিশ এমপায়ার উপাধিতে ভূষিত করা হয়। যদিও গান্ধীজী ইংরেজকে সহায়ত করার জন্য কাইজার-ই-হিন্দ উপাধিতে ভূষিত হন তবে দুজনের উদ্দেশ্য ভিন্ন ছিল। রাজবংশী ছাত্রদের শিক্ষা গ্রহণের জন্য আর্থিক  সহায়তা দেবার জন্য বর্ম কোম্পানী স্থাপন করা হয়। একটি ক্ষত্রিয় ব্যাঙ্কও স্থাপন করা হয়। পঞ্চানন বর্মণের উদ্যোগে ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলের ক্ষত্রিয় সমাজের সাথে ক্ষত্রিয় সমিতির যোগাযোগ স্থাপিত হয়। ১৯২২ সালে পঞ্চানন বর্মণ ভারতীয় ক্ষত্রিয় সমিতির সহসভাপতি নির্বাচিত হন। ক্ষত্রিয় সমিতির নেতৃবর্গের মধ্যে মত পার্থক্য থাকলেও তিনি উদ্যোগ নিয়ে পুনা চুক্তিতে রাজবংশী সম্প্রদায়কে সিডুল তালিকাভূক্ত করান। ক্ষত্রিয় সমিতির আন্দোলনের ফলে কামতা ভাষা সাহিত্যের বিকাশ ঘটে।

ঠাকুর পঞ্চানন বর্মণের নেতৃত্বে ক্ষত্রিয় আন্দোলন উচ্চবর্ণের এবং মনভোলা বর্মনের লেখা থেকে দেখা যায় যে এক শ্রেণীর ব্রাহ্মণ রাজবংশীদের উপনয়ন ধারণের তীব্র বিরোধিতা করা।

এমনকি কোচবিহার রাজ্যের দেওয়ান প্রিয়নাথ ঘোষও রাজবংশীদের উপনয়ন ধারণ করতে নিষেধ করেছিলেন। ক্ষত্রিয় সমাজের নেতৃবর্গ মনে করতেন যে রাজবংশী সমাজের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের প্রয়াসকে বহিরাগত উচ্চবর্ণরা ভয়ের চোখে দেখছে।

ঠাকুর পঞ্চানন বর্মণের ক্ষত্রিয় সমিতি আন্দোলন রাজবংশী সমাজের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে সমর্থ হলেও ক্ষত্রিয় আন্দোলনের কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল। ১৯৩০-৪০ সালে ধনেশ্বর ভট্টাচার্য্যরে নেতৃত্বে হিন্দু সমাজের মধ্যে শূদ্রের মর্যাদা দাবী করলে ক্ষত্রিয় সমিতি ঐ দাবীর বিরোধিতা করে। ক্ষত্রিয় সমিতি রাজবংশীদের ক্ষত্রিয় বংশজাত প্রমাণ করার জন্য যে সমস্ত পৌরাণিক কাহিনীর উল্লেখ করেছেন। কিন্তু কোচবিহার রাজবংশের বংশতালিকা সম্বন্ধে নীরব ছিলেন ক্ষত্রিয় সমিতির নেতৃবর্গ। তেমনি কোচবিহার রাজ্য প্রশাসন ক্ষত্রিয় আন্দোলনের তীব্র বিরোধিতা করেছিল। সম্ভবতঃ কোচবিহার রাজপরিবার কুচবিহারী জনগণের উপর তাদের আধিপত্য এবং  প্রভাব যাতে ক্ষুণœ না হয় তার জন্যই  রাজ্য প্রশাসন ক্ষত্রিয় আন্দোলনের তীব্র বিরোধিতা করে। ঔপনিবেশিক শাসনে অন্যান্য নিুবর্গের উচ্চ জাতে উত্তরণের জন্য আন্দোলনের মত রাজবংশী ক্ষত্রিয়রাও উচ্চবর্ণের মধ্যে নিজেদের স্থান করে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু বর্ণ-ব্যবস্থা উচ্ছেদের জন্য কোন আন্দোলন করেনি। তাই বাংলার নমশূদ্র, সদ্গোপ ইত্যাদি সম্প্রদায়ের আন্দোলনের ফলে ক্ষত্রিয় আন্দোলনের অনেকটা মিল পাওয়া যায়। ঔপনিবেশিক শাসন উচ্ছেদের জন্য কোন আন্দোলন করেনি ক্ষত্রিয় সমিতি। বরং ব্রিটিশ শাসনের প্রতি আস্থা জ্ঞাপন করেছিল। ‘‘We Kshtriyas are expressing our sincere and firm devotion and loyalty to the British Raj”(Kshtriya. Vol- 6 no 4, Sraban 1333, page-91)।  প্রথমদিকে ক্ষত্রিয় সমিতির সম্মেলনে কিছু মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি উপস্থিত থাকলে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের আধিপত্যের জন্য রাজবংশী মুসলিম সম্প্রদায় এই আন্দোলন থেকে দূরে সরিয়ে নেয়। জমিদার-জোতদার সম্পর্ক নিয়ে ক্ষত্রিয় চিন্তাভাবনা করলেও আধিয়ার-দের স্বার্থ সংরক্ষণে ক্ষত্রিয় সমিতি কোন ভূমিকা গ্রহণ করে নি। এক অর্থে ক্ষত্রিয় আন্দোলনকে রাজবংশী এলিট সম্প্রদায়ের আন্দোলন বলা যায়। তবে বিংশ শতাব্দীর ভারতে কোচবিহার রাজ্যের মাথাভাঙা অঞ্চলের কৃষকগণ ঋণ মুকুবের দাবীতে যে আন্দোলন শুরু করে তার অন্যতম সংগঠক ছিলেন ঠাকুর পঞ্চানন বর্মণ। সেই কারণেই তাঁকে কোচবিহার রাজ্য থেকে বহিষ্কার করা হয়। ক্ষত্রিয় সমিতি অসহযোগী এবং আইন অমান্য আন্দোলন থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রেখেছিল। সম্ভবতঃ জাতীয় কংগ্রেস উচ্চবর্ণ এবং জমিদার শ্রেণীর হাতে থাকায় ক্ষত্রিয় সমিতি ঐ জাতীয় আন্দোলনে অংশ নেয়নি। ইংরেজকে তুষ্ট করে ক্ষত্রিয় সমাজের উন্নয়ন করাই ছিল ক্ষত্রিয় সমিতির লক্ষ্য। ক্ষত্রিয় আন্দোলনের স্ববিরোধিতাও লক্ষ করা যায়। ক্ষত্রিয়ায়ণ আন্দোলনের পাশাপাশি রাজবংশী সম্প্রদায়কে সিডুল তালিকাভূক্ত করতে উদ্যোগ নেন পঞ্চানন বর্মা। কারণ হিসাবে তিনি বলেন, ‘অনগ্রসর সমাজের পক্ষে রাজনৈতিক শৈক্ষিক ও প্রশাসনিক সাহায্য ব্যতীত কেবল জাত্যাভিমান সম্বল করিয়া জাতির উন্নতি হইতে পারে না। যোগ্যতা অর্জনের সুযোগ গ্রহণের জন্য তালিকাভুক্ত হওয়া নিতান্ত আবশ্যক। স্ব-বিরোধিতা সত্ত্বেও এই সিদ্ধান্ত দ্বারা পঞ্চানন বর্মণ দূরদৃষ্টির পরিচয় দেন। ক্ষত্রিয়ায়ন আন্দোলনের পাশাপাশি দরিদ্র রাজবংশী কৃষকদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়নের মত তেমন কোন কর্মসূচী ছিল না ক্ষত্রিয় সমিতির। ক্ষত্রিয় আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা, স্ববিরোধিতা সত্ত্বেও বলা যায় ঠাকুর পঞ্চানন বর্মণ রাজবংশী সম্প্রদায়ের মধ্যে আÍমর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন শুরু করেন। তা আজও উত্তরবঙ্গে সামাজিক রাজনৈতিক এবং অর্থনীতিকে বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে প্রভাবিত করছে। এখানেই ক্ষত্রিয় সমিতির আন্দোলনের সফলতা। আর এই জন্যে ঠাকুর পঞ্চানন বর্মা নমস্য ব্যক্তিত্ব।

তথ্যসূত্র :
১॥ রণজিৎ দাশগুপ্ত : ইকনোমি সোসাইটি এ্যান্ড পলিটিক্স ইন বেঙ্গল, জলপাইগুড়ি (১৮৬৯-১৯৪৭)
২॥ স্বরাজ বসু : ডায়ানামিকস্ অব এ কাস্ট মুভমেন্ড, দি রাজবংশীস অব নর্থ বেঙ্গল, ১৯১০-১৯৪৭।
৩॥  মধুপর্ণী বিশেষ কোচবিহার জেলা সংখ্যা, ১৯৯৬। 
সম্পাদক : অজিতেশ ভট্টাচার্য।
৪॥ নির্মল চন্দ্র চোধুরী : ছোটদের পঞ্চানন বর্মা।
৫॥ উপেন্দ্র নাথ বর্মণ : ঠাকুর পঞ্চানন বর্মার জীবনচরিত।
৬॥ উপেন্দ্র নাথ বর্মণ : রাজবংশী ক্ষত্রিয় জাতির ইতিহাস।
৭॥ এ.কে.রায় : সাম নোটস অন দি ক্ষত্রিয় মুভমেন্ড।
৮॥ দি ক্ষত্রিয় সমিতি মেমোরেনডাম টু দি স্টেটুটরী কমিশন, 
ইন্ডিয়ান স্টেটুটরী কমিশন।
৯॥ খাঁ চোধুরী আমানতউল্লা : কোচবিহারের ইতিহাস।
১০॥ পার্থ সেন : স্টাডি অব সাম এসপেকটস অব দি হিষ্ট্রি অব 
কামতা-কোচবিহার সিনস্ ১৭৭২ টু দি ডেট অব একসেসন 
অব শিবেন্দ্র নারায়ণ। অপ্রকাশিত পি.এইচ ডি. থিসিস।
১১॥ পশ্চিমবঙ্গ, রায়সাহেব পঞ্চানন বর্মা সংখ্যা।
১২॥ শ্রী ঘনশ্যাম দলাই : সচিত্র কুচবিহার রাজচিত্র।
১৩॥ সূর্য্যঘড়ি দৈবযজ্ঞ :  দরং  রাজবংশাবলী।
১৪॥ ড: রমেন্দ্রনাথ অধিকারী সম্পাদিত :  
রায় সাহেব পঞ্চানন রচনাবলী। 
১৫॥ নগেন্দ্রনাথ বাসু : সোসাল হিষ্ট্রি অব কামরূপ, ভলিয়্যুম দ্বিতীয়।
১৬॥ ড: রজতশুভ্র মুখোপাধ্যায়, উত্তরখন্ড মুভমেন্ড- 
এ সসোলজিকাল এনালাইসিস, উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়।
১৭॥ এইচ.এন.চোধুরী, দি কোচবিহার স্টেট এ্যান্ড ইটস ল্যান্ড 
রেভিনিয়্যু সেটেলমেন্ট।

[  পঞ্চানন বর্মণের নেতৃত্বে রঙপুরের ক্ষত্রিয় সমিতি অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেয়। কিন্তু পঞ্চানন বর্মণের উদ্দেশ্য ছিল ইংরেজ সরকারের জনগণনা নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো।]

ভাওয়াইয়া উৎসব স্মারক গ্রন্থ : ২০০৬, ইসলামপুর, উত্তর দিনাজপুর।