ভারত ইতিহাসের মধ্যযুগে নবদ্বীপ বাঙলায় যখন শ্রীচৈতন্যদেবের আবির্ভাব ঠিক সেই সময়েই উত্তর-পূর্ব ভারতের কামরূপ কামতা রাজ্যে প্রবল পরাক্রান্ত মহাজন নরনারায়ণের ভ্রাতা বীর সেনাপতি চিলারায়ের দীক্ষাগুরু শংকরদেব কুচবিহার শহরের অনতিদূরে মধুপুর ধামে তাঁর সত্র স্থাপন করে এই অঞ্চলের রাজবংশী ক্ষত্রিয় অধিবাসীগণকে বৈষ্ণব ধর্মের মন্ত্রে আপ্লুত করেন। স্থানীয় অধিবাসীদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবনের এলো উত্তরণ। মনোশিক্ষা দেহতত্ত্ব, গুরু-শিষ্য ভাবধারা এবং কৃষ্ণপদে নিজেকে সমর্পণ করার ভাবদর্শন প্রভাবিত করলো এই অঞ্চলের মাটির মানুষের প্রাণের গান ভাওয়াইয়াকে। জীবনের জটিল প্রশ্নগুলির উত্তর খোঁজা শুরু হল ভাওয়াইয়ার দার্শনিক চিন্তাধারায়।
দেহতাত্বিক ভাওয়াইয়ার মাধ্যমে সত্যানুসন্ধানের সুরটি খুঁজে পাওয়া যায়। আত্মপোলব্ধি ঘটলে মনের ভেতরেই মেলে মনের মানুষ ––
‘‘দেহার আয়না খুলি দেখিলে হয়
দেহার পাট খুলি দেখিলে হয়
ভক্তিযোগে পরমপ্রাপ্তি, পরম সুখের সন্ধান দেওয়া আছে নির্মোহ কামনায়। সংসার অনিত্য–– শুধুই অলীক মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ মানুষ দুর্দিনের জন্যে সংসারকে আপন ভেবে লৌকিক তৃপ্তি খোঁজে। মর্ত্যলোকে সংসারের মোহ পুঁটি মাছের লোভে ‘বগা’রূপী মানুষ ‘পড়ে উড়াল দিয়া’––
‘ফাঁন বসাইচে ফাঁন্দী ভাইয়া, পুঁটি মাছ দিয়া
মাছের লোভে আজেলা বগা পড়ে উড়াল দিয়া রে।’
অনিত্য সংসারের মায়াজালে আবদ্ধ ‘বগা’ যখন জীবনের স্বরূপ বুঝতে পারে, তখন সে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা, শত টানাটুনা করেও সামান্য ‘কুঙ্কুরা’ সূতার তৈরী জালকে ছিন্ন করার ক্ষমতা তার নেই––
‘‘ ফাঁন্দে পড়িয়া বগা করে টানাটুনা
আহারে কুঙ্কুরা সূতা হলু লোহার গুণারে ॥’’
মায়া মোহে বদ্ধ জীবের মুক্তি মেলে না। তাই ভাওয়াইয়ার দর্শন বলছে––
ভবে কেউ কারও নয় সকলি পর
বেলা ডুবিলে হইবে রে অন্ধকার।
রঙ্গমঞ্চের নট-নটীর মত, হাটের ‘হাটুয়া’র মত দুদিনের আলাপ পরিচয়ের পর সবাইকে যেতে হবে অভীষ্ট মোক্ষধামে আপনদেশে একাকী––
‘‘হাটের চেনা পথের চেনারে
পাগেলা মন চেনা পরিচয়
ভবের হাট ভাঙ্গিয়া গেইলে
কেউ তো কারও নয় রে
কেউ নাই সংসারের মাঝে রে।’’
মানব দেহা নশ্বর, মিছে ঘরবাড়ি, রঙিলা দালান কোঠা।
‘‘ভাইভাতিজা কোলার নারী ‘‘ জীবন গেইলে সউগ রইবে পড়ি’’ যেদিন পাখি যাইবে উড়িয়া। ভাওয়াইয়ার দর্শনে––
মানব দেহা তোর মাটির ভান্ড
ভাঙিলে হইবে খন্ড খন্ড,
ভাঙিলে দেহা জোড়া লবে না––
মানব দেহার গৈরব কইরো না।’’
‘‘মনে কয় চিতে কয়, মিছা ঘর বাড়ি রে’’
তবে কিসের জন্যে
‘‘ঘরখানি বান্দো রে মন দুয়োর খানি ছান্দো
একেলা যাইতে হবে, কার লাগিয়ো কান্দো রে।’’
কিসের জন্যে সুরম্য অট্টালিকা নির্মাণ ? কারণ ––
‘‘দিনে দিনে খসিয়া পড়িবে
রঙিলা দালানের মাটি গোঁসাইজী
কোন রঙ্গে বান্ধিচ গোঁসাই কোন রঙ্গে ?
ভবের মায়া করে কি লাভ
‘‘দিনা দুইচারি ভবের মায়া
যেদিন পাখি যাইবে উড়িয়া
আর সেদিন
‘‘দালান কোঠা বসত বাড়ি
জীবন গেইলে সউগ রইবে পড়ি
সঙ্গের সাথী কেউতো হবে না।’’
‘বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি’র পথ সবার জন্যে সহজলভ্য নয়।
উপযুক্ত গুরুই দিতে পারেন সে পথের সন্ধান––
‘‘গুরু বিহনে রে মন কেউ তো পারে যাইতে পাইরবে না।’’
তাই তাঁর কাছেই জেনে নিতে হয় পথের সন্ধান––
‘‘গুরু উপায় বলো না
আমি অধম, সাধন-ভজন গুরু
কিছুই জানি না।’’
তাঁর কাছেই আকুতি
‘‘গুরু সকাল সকাল করো পার
বেলা ডুবিলে হইবে অন্ধকার।’’
এমন কি গুরুর কাছে যাবার মন্ত্র, পথের সন্ধান––
সেও তো তাঁর কাছ থেকেই জানতে হবে।
‘‘গুরু কোন ফুলে পূজিব চরণ গো
গুরু ফুলের কড়ি আমার ফোটে নাই।
গয়া-কাশী বারানসী গো
গুরু ব্রজে যাব আমি কোন পথে–– ?
চরণ দাও গুরু অধব জনারে।’’
গুরু মুক্তি পথের এমনই সন্ধান দেন যাতে সংসার বন্ধন তুচ্ছ মনে হয়Ñ
‘‘গুরুধন এই কি ছিল তোমার মনে
দ্যাশ ছাড়ি বৈদ্যাধশা গুরুধন করিলেন আমারে’’
বৈরাগ্যের মন্ত্রে দীক্ষা নিয়ে সন্ন্যাস যাত্রা––
‘‘কোনঠাকার কোন ভারতী আইল––
কিবা মন্ত্রে মা দীক্ষা দিল
সেদিন হাতে মাগো ঘরে না রয় মন।
যারা মুক্তিপথের সন্ধান পান না, তাদের জন্য সহজতম
মুক্তিপথের ব্যবস্থা–‘‘হরির নাম কেবলম––
‘‘হরি হরি বল মন বদনে
মন তোর দিন তো গেল বইয়া রে।
হরির নামে ঘরখানি মন কৃষ্ণের নামে বেড়া
রাধার নামে দুয়োরখানি মন বন্ধে বন্ধে জোড়া রে।’’
এই হরির নামেই ––
‘‘জগাই মাধাই পাপী ছিল
হরির নামে উদ্ধারিল
মন একবার হরি বল।’’
অপার মহিমার অধিকারী হরি, তার লীলা বোঝা দায়
‘‘ওকি দয়াল হরি, কি মায়া লাগাইলেন রে
ভবের মাঝে
এ কী হরি তোমার লীলা
সাগরে ভাসাইলেন শিলা হে
সোলা ডুবাইলেন অগম দরিয়ার জলে।’’
সংসারের সমস্ত কর্মকান্ডের মূলেই হরি–– তিনিই স্রষ্টা আবার তিনিই ধ্বংসের কারণ––
‘‘হরি তোমার লীলা বোঝা ভার
সর্প হইয়া দংশ হরি, রোজা হয়য়া ঝাড়ো
হাকিম হয়য়া হুকুম করো
সিপাই হয়য়া ধরো রে।
ভাওয়াইয়া উৎসব স্মারক গ্রন্থ : ২০০৬, ইসলামপুর, উত্তর দিনাজপুর।