July 28, 2014

প্রবন্ধ : উত্তর দিনাজপুর জেলার লুপ্তপ্রায় লোকসংস্কৃতি / মহঃ জালালউদ্দিন আহমেদ

উত্তর দিনাজপুর জেলার কথা বলতে গেলেই প্রথমেই আসে অবিভক্ত দিনাজপুর ও পশ্চিম দিনাজপুর জেলার প্রসঙ্গ। ‘দিনাজপুর’ কথা টির সাথে অতীতে ফেলে আসা অনেক ইতিহাস জড়িয়ে আছে। সেই স্মৃতি বিজড়িত ইতিহাস আলোচনা আমার প্রতিপাদ্য বিষয় নয়। তাতে বর্তমান লেখাটির কলেবর অনেকটা বৃদ্ধি পাবে। মূলতঃ দিনাজপুর জেলাটি ১৯৪৭ সালে বিভাজিত হয় এবং তার ফল স্বরূপ জন্ম নেয় পশ্চিম দিনাজপুর জেলা। সুদূর দার্জিলিং জেলার সন্নিকটে সোনাপুর থেকে হিলি থানা পর্যন্ত যার বিস্তৃতি ছিল। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কারণে জেলাটিকে দুই ভাগে ভাগ করতে হয়। উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা নামে ১৯৯২ সালের ১লা এপ্রিল ঐতিহাসিক বিভাজন হয়। প্রশাসনিক বিভাজন হওয়া সত্বেও শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক মানচিত্রে এই তিন জেলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আজও অভিন্ন। এক কথায় বলতে গেলে একই সংস্কৃতির লালনভূমিই হচ্ছে ঐতিহাসিক ‘দিনাজপুর’।

পশ্চিমবঙ্গের মানচিত্রে উত্তরবঙ্গ বলে কোন নির্দিষ্ট এলাকা চিহ্নিত না থাকলেও বহুকাল ধরেই লোকমুখে উত্তরবঙ্গ নামটি বহুল প্রচলিত হয়ে আসছে। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে ছয়টি জেলা উত্তরবঙ্গ নামে প্রচলিত।

প্রাচীন পুন্ড্রবর্ধন ছিল উত্তরবঙ্গ তথা বাংলার এক প্রাচীন নগরী। শিল্প, বাণিজ্য, শিক্ষা ও সংস্কৃতির দিক দিয়ে এই নগরী প্রাচীন বিদিশা ও শ্রাবস্তীর চেয়ে কোন অংশেই কম ছিল না। করতোয়া নদীর তীরবর্ত্তী এই নগরীর তীর্থ মাহাত্ম্য ছিল। বিখ্যাত চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং এই নগরীর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। তদানীন্তন পূর্ববঙ্গ তথা অধুনা বাংলাদেশের বগুড়ার নিকটবর্তী মহাস্থানগড়ই ছিল এই সুপ্রাচীন পুন্ড্রবর্ধন নগরী। কোটিবর্ষ ছিল প্রাচীন পুন্ড্রবর্ধনের অন্তর্গত প্রসিদ্ধ নগর। এই কোটিবর্ষেরই অন্য নাম ‘বানগড়’। বর্তমানে দক্ষিণ দিনাজপুর জেলর পুনর্ভবা নদীর তীরবর্তী গঙ্গারামপুর থানার (বর্তমানে গঙ্গারামপুর একটি মহকুমা) বানগড়ই সেই প্রাচীন কোটিবর্ষ। মুসলমান শাসনকালে এর পরিচিতি ছিল ‘দেবীকোট’ নামে। সুপ্রাচীন কোটিবর্ষের শিক্ষা, সাহিত্য, কৃষ্টি-কালচারের খ্যাতি ও মর্যাদা কৌশাম্বী, প্রয়াগ, মথুরা, উজ্জয়নী, কান্যকুব্জ ও পাটলীপুত্রের চেয়ে কোন অংশে কম ছিল না। এই ‘বানগড়কে’ ঘিরে বহু কাহিনী প্রচলিত আছে।

বর্তমানে যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। গঙ্গার ওপরে ফারাক্কাব্রীজ তৈরী হওয়ার ফলে ও উত্তরবঙ্গে অন্যান্য সড়ক নির্মাণের জন্য বাসে ও ট্রেনে যোগাযোগ বেড়েছে দেশের ও রাজ্যের অন্যান্য অংশের সঙ্গে। গড়ে উঠেছে নতুন নতুন শহর ও গঞ্জ। উত্তরবঙ্গের শহর ও গঞ্জে আজ নানান বহিরাগত সংস্কৃতির সংমিশ্রণ ও সহাবস্থান লক্ষ্য করা গেলেও কৃষি নির্ভর গ্রামীণ জীবন ধারায় আধুনিক সংস্কৃতির চটুল চমক প্রাচীন লোককথা, লোকগান, লোকপালা, লোকনাট্য, লোকসঙ্গীত ও লোক-সংস্কৃতিকে এখনো পুরোপুরি ধ্বংস করে ফেলতে পারেনি বলে আজও কিছু কিছু লোক সংস্কৃতির মূল্যবান উপাদানের সন্ধান মেলে উত্তরবাংলার অন্যতম জেলা নবগঠিত উত্তর দিনাজপুর জেলায় হাঁটি হাঁটি পা-পা করে প্রায় একটা দশক অতিক্রান্ত করেছে সদ্যজাত এই শিশু জেলাটি।

এই জেলায় বসবাস করেন নানা ধর্ম, বর্ণ ও সম্প্রদায়ের মানুষ। এখানকার উচ্চবর্ণের মানুষেরা পূর্ব কিংবা দক্ষিণ বাংলার লোক। এর অধিকাংশটাই দেশ বিভাগের ফলে এখানে এসেছে। পূর্বেই যারা এসেছে তাদের মধ্যে ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, সদ্গোপ ও মাহিষ্য প্রভৃতি শ্রেণীর মানুষেরা আছেন। আবার তপশীলী সম্প্রদায়ের অন্য শ্রেণীর মানুষেরা আগে থেকেই আছে, পরবর্তীকালেও অনেক এসেছেন। তপশীলি জাতি ও উপজাতির সংখ্যা প্রায় অর্ধেক। বাকি অর্ধেকের মধ্যে রয়েছে বাঙালি, অবাঙালি, বর্ণহিন্দু ও মুসলমান জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ। এই জেলায় স্থানীয় মুসলমান ছাড়াও মালদা, মুর্শিদাবাদ ও বীরভূম জেলার কিছু মানুষ এখানে চার থেকে পাঁচ দশকের মধ্যে এসেছেন। কারো মতে এরা শেরশাহের বংশধর বলে ‘শেরশাহ বাদিয়া’ নামে পরিচিত। যারা ভাটিয়া সম্প্রদায়ের মানুষ বলে সুপরিচিত, ‘ভাটি’ অঞ্চল থেকে এই সমস্ত মুসলমানরা এসেছেন বলে তাদের ‘ভাটিয়া’ বলে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। বিভিন্ন শ্রেণীগোষ্ঠী বা ধর্মে এই এলাকায় তারা সংখ্যার দিক থেকে নগন্য হলেও কৃষ্টি ও কালচারের দিক থেকে তাদের প্রাধান্য বিরাজমান। এদের যে সংস্কৃতির প্রাণ-প্রবাহ এখনও চলমান, তাকে বলা যাবে এই জেলার অন্যতম লোকসংস্কৃতি। ইসলামপুর মহকুমার অনেক অঞ্চলের মানুষের ভাষা ভিন্নতর। এখানকার মানুষেরা আধো আধো বাংলায় যে কথাবার্তা বলে থাকেন তাই হচ্ছে বর্তমান রাজবংশী ভাষার এক বিশেষ রূপ। প্রকৃতপক্ষে আমরা যাকে বলি রাজবংশী ভাষা; তাকে ভাষা-বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলে ‘কামরূপী ভাষা বা কারো মতে তিব্বতধর্মী ভাষা। এই বিশেষ অঞ্চলের উপভাষা মূলতঃ ‘সূর্য্যাপুরী’ উপভাষা নামে বহুল প্রচিলিত। উত্তর বাংলার তপশীলি জাতির মধ্যে সংখ্যা গরিষ্ঠ সম্প্রদায় হচ্ছে ‘রাজবংশী’ (সূর্য্যবংশীয়) ও ‘পোলিয়া’ সম্প্রদায়। এছাড়াও রয়েছে তিয়র, তুরী, বাগ্দী, বিঁদ, বেলদার, ভুঁইমালী, দোসাদ, মাহাতো, কুরমী, কৈরী, দুলেহ, কামী, কোচ, মুশাহার, পাশোয়ান, কাপালিক, নমঃশুদ্র, জেলে, জালিয়াকৈবর্ত্য, নুনিয়া, চৌপাল, আনসারী (জোলা) সাঁওতাল, ওঁরাও, বাঁশমালী কাহার প্রভৃতি সম্প্রদায়ের মানুষ। এদের ভাষা মূলতঃ অস্ট্রো-এশিয়াটিক। এই রাজবংশীরা ‘কোচ’ সম্প্রদায় থেকে উদ্ভূত। তাছাড়া কারো মতে এই রাজবংশীরা ‘দ্রাবিড়’ গোষ্ঠীর লোক বলে তাদের মধ্যে মঙ্গোলীয় রক্তের সংমিশ্রণ ঘটেছে। বিগত প্রায় একশো বছর ধরে রাজবংশীরা হিন্দু ধর্মের সংস্পর্শে এসেছে এবং হিন্দুদের আচার-আচরণ ও রীতিনীতি অনুকরণ করেছে ততই তারা জাতি হিসেবে সচেতন হয়ে উঠেছে বে৩ নিজেদের কোন উপজাতীয় পরিবারভুক্ত বলে মনে করাও চরম বিরোধিতা করেছে। আধুনিক সভ্যতার সংস্পর্শে আসার ফলে রাজবংশীদের পোশাক-পরিচ্ছদ, আচার-ব্যবহার, জীবন-যাপনের গতানুগতিক ধারাতেও ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। বিভিন্ন লৌকিক দেবদেবীর পূজা, পার্বণ, ব্রত, বিবাহ ও অন্যান্য অনুষ্ঠানে যে বৈচিত্রময় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য যুগযুগ ধরে এরা অনুসরণ করে আসছিল এবং মৌখিক সাহিত্যের বিপুল ভান্ডারের অধিকারী ছিলÑ সেইসব ক্রমশই আজ বিলুপ্তির পথে। আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতার গরল প্রবাহে রাজবংশী আদিবাসী ও অন্যান্য পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের লোকসংস্কৃতি ও লোকসাহিত্য আজ বিপন্ন হতে চলেছে।

সাধারণভাবে ‘লোকসংস্কৃতি’ বলতে আমরা ব্যাপকতর জনসাধারণের জীবনচর্চার ব্যাপকতম ধারাকে যা বিভিন্ন ধারার মধ্য দিয়ে সাধারণ নর-নারীর ভাষা, ধর্ম বিশ্বাস, আচার-আচরণ, ধ্যান-ধারণা, উৎসব-অনুষ্ঠান, শিল্পকলা ও মৌখিক সাহিত্যের প্রকাশ ঘটে থাকে। গ্রামের মানুষরাই এই সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। লোকসংস্কৃতি হচ্ছে সমাজের দর্পণ স্বরূপ। এর মধ্য দিয়ে সমাজের বৈচিত্রময় জীবনের নানান প্রতিচ্ছবি ব্যাথা-বেদনার মূর্ত চিত্র প্রতিফলিত হয়ে থাকে। যাকে বিশেষ জনগোষ্টী ঐতিহ্য অনুযায়ী বংশ-পরম্পরায় লালন করে থাকে যা কোন বিশেষ কোন কালের গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ থাকে না, যা অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের মধ্যে একটা অবিচ্ছেদ্য যোগসূত্র রচনার করে থাকে যার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো মৌখিক ও লিখিত রূপ তাকেই ‘লোকসংস্কতি’ বলে চিহ্নিত করা যেতে পারে।
আমাদের জেলার লোকসংস্কৃতি কয়েকটি আঙ্গিকে ভাগ করে সংক্ষিপ্তভাবে আলোচনা করা যেতে পারে।

লোকনাট্য  :
‘খণগান’ : উত্তর দিনাজপুর জেলর কিছু কিছু অঞ্চলে ‘খণগান’ খুবই প্রচলিত ও জনপ্রিয়। ‘ক্ষণ’ শব্দটি সংস্কৃত ভাষা থেকে উদ্ভূত হয়েছে। তাৎক্ষণিকভাবে এই লোকগান রচিত ও গাওয়া হয়ে থাকে বলে এর এই নাম। উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন লোকনাট্যের মধ্যে এই ‘খণগান’ বা খ্যেনের গান নানান কারণেই বিশেষ উল্লেখের দাবী রাখে। সাধারণতঃ পারিবারিক বা সামাজিক কোন রোমান্টিক কাহিনী, সংঘর্ষ বা প্রেমবিষয়ক কোন কেচ্ছা কাহিনীকে কেন্দ্র করেই রচিত হয়ে থাকে এই ধরনের লোকনাট্য। গোপন প্রণয়, কুলত্যাগ, অসবর্ণবিবাহ, বিবাহ-বিচ্ছেদ, তালাক, কেস, মামলা-মোকদ্দমা প্রভৃতি সামাজিক বিষয়কে কেন্দ্র করেই জমজমাট হয়ে ওঠে এই নাটক। সাধারণতঃ মুক্ত মঞ্চেই এইসব রসাÍক, কৃষি কাজের নানান উপমা, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, মস্করা, তামাসা, হাসিঠাট্টা, অবহেলিতা-বঞ্চিতা-লাঞ্ছিতা ও নির্যাতিতা রমনীদের আকুলতা-ব্যাকুলতার জ্যান্ত ছবি প্রভৃতি এই জনপ্রিয় লোকনাট্যের প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয়। এই ধরনের নাটকে যেমন সংলাপ আছে, তেমনই প্রতি বছরই নতুন নতুন বিষয়বস্তু নিয়ে রচিত হয় বলে নাটকের উপর মানুষের প্রচুর আগ্রহ জন্মায়। এইসব পালাগানে নারীচরিত্রে সাধারণতঃ পুরুষরাই (ছাক্রা সেজে) অভিনয় করে থাকে কোন কোন পালা গানে। আমাদের জেলায় এই গানের ঐতিহ্য দীর্ঘদিনের। রায়গঞ্জ, কালিয়াগঞ্চ, হেমতাবাদ, ইটাহার প্রভৃতি অঞ্চলের আশেপাশে এই লোকনাট্যের ব্যাপক প্রচলন আছে। স্বাধীনতা পরবর্তী যুগে যেসব ‘খণগান’ অত্যধিক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল সেগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো ভাসুর-ভাউসান, বুধাশরী, দইফেলা সেহারী, সাইকেল সেহারী, সতী-হেলা, হ্যাজাক সেহারী, ডিপ্টিকল, লালু-সোহাগী, হালুয়ান-হালুয়ানী, চোর-চূর্ণী প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। ‘খণগান’ বিভিন্ন নামে বিভিন্ন দলকর্তৃক এক একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে পালাগান হিসেবে গীত হয়। গানগুলি কত রসাÍক হয় যেমন- 
‘‘ শীতকালে  আগুনি মিঠা
গ্রীষ্মকালে যাব (বাতাস)
গাভুর (যৌবনে) কালে পীরিতি মিঠা
শিশুকালে মাও।’’

রাজবংশী ও কোচ সম্প্রদায়ের মধ্যে ‘ভাসুর-ভাউসান’ পালাটি গ্রামের সাধারণ জনগণের মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। বিধবা ভাইয়ের বউকে ‘ভাসুর’ তার অনুরাগ জানালে ‘ভাউসান’ তীব্র আপত্তি জানায় এবং এই গান শোনায় :

কি কথা কহেন গো ভাসুরা ?
পীরিতির কথা আর না নাগে ভাল
মুই অভাগী (রাঢ়ী) কাঁচা চুলে হারানু সোয়ামী।
পীরিতির কথা মোক্ আর কহেন না।’’

অবশ্য শেষ পর্যন্ত ভাউসানের মত বদলায় এবং স্বামী-স্ত্রীরূপে তারা ঘর-সংসার করতে থাকে। কিছুদিন সমাজে হৈ চৈ হলেও পরে সব শান্ত হয়ে যায়। এই রকম অনেক ঘটনা থাকে এই লোকনাট্যে।

এই জেলার অন্যান্য জনপ্রিয় পালাগানের নাম বন্ধ-পাঁচালী, নয়নসরি, বোস্টম বাউদিয়া পালা, অম্বলসরি পিছল বাউদিয়া পালা, জলমাংগা গান প্রভৃতি। হিন্দু সমাজের মতই মুসলমান সমাজে আল্লা মেঘ দে,  পানি দে’-এর মত কোথাও কোথাও জামাত করে  ‘এস্তেস্কা নামাজ’ও পড়া হয়ে থাকে অনাবৃষ্টিতে জলের জন্য। তাছাড়া ‘কানি বিষহরি গানের পালা’, ‘রামের বনবাস’, রাম-রাবণের পালা, সত্যপীরের গান ও ব্যাপকভাবে আমাদের জেলায় প্রচলিত। টুঙ্গিদিঘী অঞ্চলে প্রতিবছর সারা ভাদ্রমাসব্যাপী চেঙমুড়ি বিষহরি অর্থাৎ বেহুলা-লক্ষিন্দরের পালা গান খুবই জনপ্রিয়। এখানে রাজু মন্ডলের একটা দল আছে। তারা জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আমন্ত্রণ পেয়ে থাকে। গতবছর রাজু মন্ডল ও তার সম্প্রদায় শিলিগুলি বেতারকেন্দ্রে আমন্ত্রণ পেয়েছিল। এগুলি জেলার লোকসংস্কৃতির এক অমূল্য সম্পদ। জেলার সংস্কৃতির ভান্ডার পরিপূর্ণ কিন্তু সংরক্ষণের কোন ব্যবস্থা সরকারী বা বেসরকারী  কোন পর্যায়েই নেওয়া হয়নি। দুঃস্থ শিল্পীরা আর্থিক কষ্টে ভুগছে। কিছু সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষদের ব্যক্তিগত উদ্যোগে এইসব জনপ্রিয় পালা এখনও টিকে আছে।
সত্যপীর বা সইত্পীরের গান :
এইসব ধর্মীয় গীতে রয়েছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সুর। তাছাড়া এই ধরনের নাটক ও গানগুলো ধর্মনিরপেক্ষ ও সামাজিক নিয়ম-নীতি মেনে রচিত বা অভিনীত হয়ে থাকে। বহুদিন ধরে চালু থাকে এই নাটকগুলো এদের এক অদ্ভূত সৃজনী প্রাণশক্তির গুণে। তবে নীতিকথাও থাকে লোকশিক্ষার জন্য। খনগানের মতোই এইসব পালাটিয়া গানও মুক্তমঞ্চে অভিনীত হয়ে থাকে। অসংখ্য দর্শক ঘিরে থাকে চারপাশে। দর্শককুলের অবসরকালীন চিত্রবিনোদন ও মনোরঞ্জন করাই হল এর মূল উদ্দেশ্য। তাছাড়া আমাদের উত্তর দিনাজপুর জেলায় একদা গুণাই যাত্রা, রহিম-রূপবান, আলকাপ পঞ্চরস, লায়লা-মজনু, আসমান-তারা, ইউসুফ-জেলেখা প্রভৃতি পালাগানগুলি বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। চোপড়া ও বিলাসপুর অঞ্চলে অভিনীত সত্যপীরের গানের একটি অংশ এখানে উল্লেখ করা হল। যেমন :

    ‘‘পীর বলিছে আমি নাম রাখিব
দুই ফলের মধ্যে আমি সেবা পূজা নিব।
হিঁদুর দেব্তারে যাইয়ো মোসলমানের পীর 
দুই ফুলে নিব সেবা করিয়া জাহির।
হিঁদুর ঘরে নিব আমি প্রসাদ আর পানি।
আর মোসলমানের ঘরে নিব তিন কড়া সিরনী।’’

বাংলার বৃহত্তর লোকজীবনের লৌকিক ধর্মের অনুশীলন ও আচার অনুষ্ঠানে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে সাম্প্রদায়িক ঐক্যের অভাব অনুভূত হয়নি কোনকালেই। জেলার বিভিন্ন অংশে সত্যপীর, মানিকপীর, ঝুঁটিয়াপীর, তোর্সাপীর, ঘোড়াপীর, খন্দকারপীর, ল্যাংড়াপীর, জ্যাঠাপীর মখ্দুম পীর, বালাপীর, বদরপীর প্রভৃতি পীরগণ পূজিত হয়ে থাকেন।
সত্যপীরের আর একটি অতি বিখ্যাত ও জনপ্রিয় গান যেমন : 

‘‘শুন শুন ওহে ভাই
আজান-কেত্তন আর নয় !
হরি আর আল্লারে
একাসনে পাওয়া চাই।
আল্লা-হরি হরিবোল
এই ধ্বনি তোল ভাই।’’
বিহারসংলগ্ন মতিগঞ্জ ও ফতেপুরে এইসব গান এখনও গাওয়া হয়।

এইসব গান ছাড়াও আমাদের এই পিছিয়ে পড়া জেলায় অজস্র ভক্তিগান, দেহতত্ত্বগান, ভাবতত্ত্বগান, সাধুগান, বাউলগান, পীর-ফকিরীগান, দরগার গান, মুর্শিদীগান, মারফতীগান, রাধা-কৃষ্ণ বিষয়ক গান, মণিমুক্তার মত জেলার গ্রামে-গঞ্চে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। করণদীঘি থানার টুঙ্গিদীঘি ও ঝাড়বাড়ি অঞ্চলে বিষহরি গান (পালা) ও পদাবলী কীর্তন খুবই জনপ্রিয়। টুঙ্গিদিঘির জুঝারপুর এলাকায় তারকব্রহ্ম কৃষ্ণ-রামের গোষ্ঠ উৎসব সাম্প্রতিককালে অত্যাধিক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। এখানে হাজার হাজার মানুষের সমাগম হয়ে থাকে।

লাঠি খেলা, জংগ ও ঝারনীগান  :
মহরম পর্বকে কেন্দ্র করে মুসলমান সমাজে এই সব খেলা ও গান গাওয়া হয়ে থাকে। কারবালার যুদ্ধে হজরত মোহাম্মাদের দুই দৌহিত্র শহিদ হাসান ও হোসেনের সাথে এজিদের লড়াইয়ের বৃত্তান্ত নিয়ে মুসলিম সমাজের হৃদয়বিদারক গান। ধর্মীয় শোক উপলক্ষ্যে কোথাও কোথাও তাজিয়াসহ লাঠি খেলা, জারী ও ঝারনীগান  গাওয়া হয়। তাতে ঢোলসহ বিভিন্ন বাজনা বাজানো হয়। এইসব গান প্রায় লুপ্ত হওয়ার পথে। করণদিঘী থানার রাঘোবপুর, খোয়াসপুর ও কামারতোর প্রভৃতি এলাকায় মহরম উপলক্ষ্যে বিরাট মেলা বসে ও প্রতিযোগিতাপূর্ণ আসর জমে ওঠে।

মুখোস নৃত্য  :
লোকনাট্যের কোন কোন অংশে একক নৃত্যের অবকাশ থাকে। নিজস্ব অঙ্গভঙ্গীতে সাধারতঃ নায়ক-নায়িকারা নাচের আসর জমায়। তাছাড়া উদ্দাম নৃত্য দেখানো হয় মুখোশের নাচে। গম্ভীরা ও জিতিয়া অষ্টমী উপলক্ষ্যে মুখোশ নাচের পৃথক আসর বসে। দলে দলে সুসজ্জিত হয়ে ঢোল ও বাজানার তালে তালে কখনও ধীরে আবার কখনও উত্তেজিতভাবে নৃত্য চলতে থাকে। স্থানীয়ভাবে একে মুখা নাচ বলে। ঢোল বাদক ও নৃত্যকারী শেষ পর্যন্ত বাহ্যিকজ্ঞান হারিয়ে ফেলে। মোখা আমাদের জেলার একটি ঐতিহ্যবাহী লোকশিল্প। এই জেলার মুখোশ শিল্পটি প্রতিবেশী রাষ্ট্র নেপাল হয়ে তিব্বত চীন ও শ্রীলঙ্কায় চলে যাচ্চে বাণিজ্যিক কারণে। এগুলো সম্পর্কে ভাবনা চিন্তা খুবই প্রয়োজন। এই মুখোশ শিল্প জাপানের টোকিও শহরে খুবই সমাদৃত।

অপর দিকে রাজবংশী সম্প্রদায়ের লোক-সংস্কৃতির সাথে মুসলমান সমাজেও এই স্রোত গিয়ে পড়েছে। তাদের লৌকিক আচার-অনুষ্ঠানে যেমন বিবাহ, খাত্না-সুন্নত (মুসলমানী), আখিকা প্রভৃতি অনুষ্টানেও এর ছাপ লক্ষ্য করা যায়। তাদের বিয়ের আগে হলুদ বাঁটা অনুষ্ঠানের গানটি খুবই সমাদৃত। চাকুলীয়া থানার কাহানিয়া ও গোয়ালপোখর থানার ধরমপুর অঞ্চলের একটি বিখ্যাত বিয়ের গান যেমন :

‘‘হলদানি বাটিতে গো বুবু
কি ঘাসন ঘাসিলেন
কি কি গান মাংগাকেন গো বুবু।
ছেলের জন্য মাংলি লো বুবু
দুধু খাওয়া বাটি 
আর সোয়ামির জন্য মাংলি লো বুবু
শান্তিপুরের ধুতি।”

মুসলিম সমাজে ‘বুবু কথাটির খুবই প্রচলন আছে। তারা দিদিকে বুবু বলে সম্বোধন করে থাকে। তাই নিঃসন্দেহে এই সংস্কৃতি আমাদের এই পশ্চাদ্পদ জেলার নিজস্ব সংস্কৃতি। এই লুপ্তপ্রায় সংস্কৃতির ব্যাপক অনুসন্ধান ও পরিচয় প্রচানের মধ্য দিয়ে আমাদের সংস্কৃতির নিজস্বতাকে যেকোন মূল্যে রক্ষা করতেই হবে।

লোকসংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদানগুলো যে কোন দেশ বা জাতিরই অতি গৌরবের সামগ্রী। কোন একটা দেশের লোকজীবন ও তার প্রাচীন ধারা বা ঐতিহ্যকে যথাযোগ্যভাবে পর্যালোচনা করতে গেলে লোকসংস্কৃতির সাহায্য নিতেই হবে। রাজনৈতিক ও জাতীয় জাগরণের ক্ষেত্রেও লোকসংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদানগুলো নিতে পারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। জাতীয় ঐক্য, সংহতি ও জাতীয় গৌরবের পুনরুত্থানে লোকসংস্কৃতির অপরিসীম গুরুত্ব দিয়ে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো শ্রেণী সংগ্রামের প্রসারে যথেষ্ট ইতিবাচক সাফল্য পেয়েছে। পশ্চিমের উন্নত দেশ ও সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে তাই আজ লোকসংস্কৃতি গুরুত্ব পাচ্ছে ভীষণভাবেই। দেরীতে হলেও বর্তমানে আমাদের দেশেও লোকসংস্কৃতি গুরুত্ব পেতে শুরু করেছে এবং এই লুপ্তপ্রায় সংস্কৃতি চর্চাতেও এগিয়ে আসছেন আজ বহু বিদগ্ধ মানুষ। অবশ্য গ্রামীণ লোকসংস্কৃতির দ্রুত অবক্ষয় বা অবলুপ্তির জন্য শুধু যে আধুনিক নগরকেন্দ্রিক সংস্কৃতির আগ্রাসী ভূমিকা দায়ী একথা জোর দিয়ে বলা যায় না। এর পিছনে আরো অনেকগুলো কারণ আছে। বহু যুগ ধরে গ্রামগুলোকে গড়ে উঠেছিল কৃষিকেন্দ্রিক সংস্কৃতি। সত্য কথা বলতে কি আজ আধুনিক সভ্যতার দ্রুত বিকাশ ও উৎপাদন ব্যবস্থার পরিবর্তন তীব্র জীবন সংগ্রাম, বিশ্বায়ন, উদারীকরণের   আগ্রাসী  প্রভাবে গ্রামের সনাতন জীবনধারায় লেগেছে ব্যাপক পরিবর্তনের ছোঁয়া এবং এর সার্বিক প্রভাব পড়েছে লোকসংস্কৃতির উপরে। আর সর্বোপরি, নগরকেন্দ্রিক সংস্কৃতির প্রবল তাড়নায় গ্রামীণ লোকসংস্কৃতি কোণঠাসা হতে হতে আজ অবলুপ্তির দ্বার প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। গোটা বিশ্বব্যাপী গ্রামীণ লোকসংস্কৃতি আজ বিপন্ন। বিপন্ন ভারত, গ্রামবাংলা তথা আমাদের প্রিয় নবজাত জেলা উত্তর দিনাজপুরের লোকসংস্কৃতিও। আসুন, আমরা সকলে মিলে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্ঠা নিয়ে এই মূল্যবান সম্পদকে টিকেয়ে রাখার শপথ গ্রহণ করি।

ভাওয়াইয়া উৎসব স্মারক গ্রন্থ : ২০০৬, ইসলামপুর, উত্তর দিনাজপুর।