![]() |
নির্মল দত্ত মোবাইল : 94743-85123 |
অর্থাৎ প্রতি দুমালি পর পর যেমন জলের স্তর বদলে যায় তেমনি প্রতি চার মাইল পর পর ভাষা। এত কিছুর পরও ইসলামপুর মহকুমার গ্রামীণ এলাকার লোকসংস্কৃতি, পূজা-পার্বণ, লোকগান এখনো আগের মত রয়ে গেছে। মহকুমার লোকশিল্পী এবং ধর্মানুরাগের কল্যাণে বিষহরি (মনসা), ধাম বা ধরম ঠাকুর, গ্রাম, মাশান, ঘাটো, গরু চুমানী, দধিকাদো, পীড়ের পূজো আজও হয়। লোক সঙ্গীত এবং লোক সংস্কৃতির হিসাবে চৈত্য, খন, জলমাংগা, চোর-চুর্ণী, মোখা নৃত্য (মুখোশ নাচ), সত্যপীড়, বাউল, ভাটিয়ালী, ভাওয়াইয়া, বন্ধু-ওয়ালা প্রভৃতি গান ইসলামপুর মহকুমায় যথেষ্টই সমাদৃত। এখানে পূজা-পার্বণ এবং গান সম্পর্কে কিছু কিছু তুলে ধরছি।
বিষহরি পূজা (মনসা) : ইসলামপুর মহকুমার সর্বত্রই হিন্দু বিশেষ করে রাজবংশী এবং পলিয়া সম্প্রদায়ের সব পরিবারেই বিষহরির পূজা হয়। কোথাও কোথাও বিষহরির পালা গানও হয়ে থাকে।
গ্রাম পূজা : এই পূজা সাধারণতঃ গ্রামের প্রবেশ পথে বিষ্ণুর অনুরূপ মূর্ত্তি গড়ে পূজা করা হয়। গ্রামীণ মানুষের বিশ্বাস, এই দেবতা ডাকাত এবং অমঙ্গলের হাত থেকে গ্রামকে রক্ষা করে। পূজার কবুতর বা পায়রা বলি দেওয়া হয়।
ধামার বা ধরম ঠাকুরের পূজা : এই পূজাও গ্রামের ফাঁকা স্থানে হয়। হাতীর পিঠে উপবিষ্ট চতুর্ভূজ মূর্তিকে মানুষ ভক্তিভরে পূজা করে। বিশ্বাস এই পূজা করলে গ্রামে কোন রোগ-মহামারী হয় না। ধরম ঠাকুর গ্রামকে রক্ষা করে।
মাশান পূজা : মাশান শব্দটি শ্মশান অর্থে ব্যবহৃত হয়। ইসলামপুর থানর পূর্বাঞ্চলের মানুষ মাশান অর্থাৎ শ্মশান দেবতার পূজা করে। গ্রামে যাত মহামারীতে বহু মানুষের মৃত্যু না হয় তার জন্য অদ্ভুত দর্শন কালি মূর্ত্তি তৈরী করে পূজা করে।
ঘাটো পূজা : এই পূজো হয় ১লা বৈশাখের সন্ধ্যায়। সমগ্র চৈত্র মাস মহিলারা নিয়ম-নিষ্ঠার সঙ্গে ব্রত পালনের পর ১লা বৈশাখ সন্ধ্যায় মহানন্দা-ডক নদীর ঘাটে গিয়ে সমবেত হয়। এদের হাতে থাকে ছোট-ছোট কলার ভেলা, প্রদীপ, ধুতরা ফুল, ছাতুর নৈবেদ্য। ভেলার ওপরে প্রদীপ জ্বেলে সেই ভেলাকে নদীর জলে ভাসিয়ে দেবার আগে ছাতুর নৈবেদ্য, ধুতরা ফুল দিয়ে ঘাটোর পূজা করে। অনেক সময় পায়রার গলা ছিঁড়ে রক্ত নদীর জলে ছিটিয়ে দিয়ে সংসারের সমৃদ্ধি এবং পরিবারের যারা বাইরে থাকে তাদের মঙ্গল কামনায়। ঘাটোকে উদ্দেশ্য করে গড়ে ওঠে বিরহের গান ––
তুই মোক ছাড়িয়া পালাল গে বিদেশ
ও মুই বেড়াউ কান্দিয়া।
শুনি হামরা মাই-বাপের রুধুনা
ওরে তোর মায়ের কান্দনে মাহান্দি লোদি বহে
ওরে তোর বাপ কান্দেছে বাইরি ঘরৎ বসে
ওরে তোর ভাইর কান্দনে বুক ভিজিয়া যাছে।
এই ঘাটো পূজাই উত্তরবঙ্গের অন্যান্য জেলায় তিস্তা বুড়ির পূজা হিসাবে প্রচলিত আছে।
গরু-চুমানী : দেবী পূজার (দুর্গা)পর কার্ত্তিক মাসের
অমাবস্যায় সারা রাজ্য যখন কালী পূজা বা দীপাবলী উৎসবে মেতে ওঠে তখন এই মহকুমার গ্রামীণ এলাকার মানুষ শুরু করে দুদিনের গরু-চুমানী পূজা। প্রথম দিন গৃহস্থ তার বাড়ির গরু-মহিষ-ছাগলকে øান করিয়ে পরিস্কার করে। সন্ধ্যায় একটি নতুন কুলায় ধান, দূর্বা, পঞ্চপ্রদীপ, জোড় সংখ্যা বিশিষ্ট মদুয়া কলা, পান, সুপারী সিঁদুর এবং সরিষার তেল নিয়ে বরণডালা সাজিয়ে গোধূলী লগ্নে গরু-মহিষকে গেয়াল ঘরে তুলে বরণ করা হয়ে। গরু মহিষের কপালে তেল, সিন্দুর পরিয়ে দেওয়া হয়। শিং-এ মাখানো হয় তেল। একেই বলা হয় গরু-চুমানী। পরদিন হয় গড়েয়া পূজা।
গড়েয়া পূজা বা গরু পূজা : গোয়াল ঘরে কাঁচা গোবড় দিয়ে দুটি মূর্ত্তি অর্থাৎ গড়েয়া-গড়েয়ানী তৈরী করা হয়। এই মূর্ত্তি দুটিকে কাঁচা দুধ, কলা, পায়েস, মুড়ি, বিচি-কলা, হাঁসের ডিমকে (কাজল-সিন্দুর পরানো) একটি চালুনে রেখে গোয়াল ঘরেই পূজা করা হয়। পরে পুজোর উপকরণসহ চালুনীটি গোয়াল ঘরের মধ্যেই পুঁতে দেওয়া হয়। এদিনই গরুকে ‘বাখর’ খাওয়ানো হয়। গরু রাখালকে নতুন গামছা এবং ছোট লাঠি উপহার দিয়ে তার মাথায় দেওয়া হয় প্রচুর সরিষার তেল। এদিন গাছের ফল বৃদ্ধির জন্য গাছের কান্ডে খড়িমাটি দিয়ে বেড় অথবা কলা গাছের পাতা বেঁধে দেওয়া হয়।
হুকা-হুকী : অমাবস্যার সন্ধ্যায় গ্রামের বাইরে মাটি দিয়ে একটি ঢিবি তৈরী করে তাতে সিঞ্জা(পাটকাঠি) পুঁতে দেওয়া হয়। সন্ধ্যায় গ্রামে মানুষ সেখানে সমবেত হয়ে সিঞ্জার ছোট ছোট বান্ডিল হাতে নিয়ে তাতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে আকাশের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে গাইতে থাকে ‘‘দাদা গে, দিদি গে, আলই লে . . . . . ইত্যাদি। পরে বান্ডিলগুলো ঢিবিতে ছুঁড়ে দেওয়া হয়। এভাবেই এলকার মানুষ তাঁদের পূর্ব-পুরুষকে আলো দেখায়।
এই এলকার মুসলীম সম্প্রদায়ের মানুষরা ধর্মান্তরিত হওয়ার কারণে এদের মধ্যে এখনো হিন্দুদের মত বিয়ের গান, ভাদর কাটানী, পৌষ কাটানী এরূপ অনুষ্ঠান এবং আচার-আচরণ পালন করা হচ্ছে।
এই মহকুমার প্রায় প্রতিটি পরবের সঙ্গে রয়েছে গানের একটা নিবির সম্পর্ক। চৈতা হচ্ছে এরূপ একটি বিখ্যাত গান। হিন্দি-বাংলা-মৈথিলি এবং পালি ভাষার সংমিশ্রণে এই গান গাওয়া হয়। চৈত্র মাসে গাওয়া হয় বলে এই গানকে চৈতা গান বলা হয়। পুরুষরা মাদল বাজায় মেয়েরা গান করে। চৈতার বিরহের গান যেন শিল্পীর অন্তর থেকে উৎসারিত, এর সুরও বড়ই মধুর। যেসব মহিলা এই গান করে তাদেরকে চৈতা বলা হয়। চৈত্রের আগুন ঝড়া দুপুরে চৈতা শিল্পী গেয়ে ওঠেন।
শুন হরি নগরিয়া, সৈঁয়ারে বিনে
হামরে মরি, রামা–
সৈঁয়া বিনা শূন্য ভেলে।
অন্নধন যৌবন কি লাগি বাঢ়ালি
ছোট-ননদি হো !
হামরে মরি, রামা–
কি লাগি বাঢ়ালি
নব কেশয়া।
(শোন হে নগরবাসী, প্রিয়জন বিহনে আমি মরি, প্রিয় বিনা সবকিছু শূন্য হয়ে গেল। অন্ন, ধন, যৌবন সবই বৃথায় গেল। কিসের জন্য চুলের এই নব সাজ !)
এই গান ইসলামপুর মহকুমার সোনাপুর অঞ্চল ছাড়া আর কোথাও শোনা যায় না। এই এলাকারই বিখ্যাত হচ্ছে ‘বন্ধু আলা’ গান। এই এলকার রাজবংশী, পলিয়া সম্প্রদায়ের বিশেষ গান। এই গানের জন্ম পাথারে (মাঠে)। গানের সঙ্গে কোন বাদ্যযন্ত্র থাকে না। ফাল্গুন-চৈত্র মাসের পছিয়া (পশ্চিমা বাতাস) যেন এর আবহসঙ্গীত। কৃষক একাকী জমিতে হাল চালাতে চালাতে পছিয়ার স্রোতে ভাসতে ভাসতে আনমনে গেে ওঠে এই গান। পছিয়ার ডানায় ভর করে এই গানের সুর ছড়িয়ে পরে বিস্তীর্ণ প্রান্তরে। প্রেমিক-বন্ধুকে উদ্দেশ্য করে গাওয়া এই গানের সুর বড়ই করুণ। পছিয়া ছাড়া এই সুর ওঠে না। এই মহকুমায় চৈতা, বন্ধু আলা ছাড়াও গাওয়া হয় চোর-চূর্ণীর গান। দল বেঁধে বাড়ি বাড়ি গিয়ে এই গান গাওয়া হয়। এই গানের মধ্যে যেমন সামাজিক অবিচারের কথা বলা হয় তেমনি পারস্পরিক সম্পর্কের কথাও বলা হয়। যেমন––
চোর গেইসে চুরি করবা
চূর্ণী নান্দিছে ভাত
চোরের তানে নান্ধিয়া রাখিছে
জিয়াল মাগুর মাছ।
এই মহকুমায় মোখা নাচ (মুখোশ) খুব নিষ্ঠার সঙ্গে করা হয়। নির্দিষ্ট কিছু লোক ছাড়া মোখা তৈরী কেউ করে না। মোখা তৈরীর ক্ষেত্রে অনেক নিষ্ঠার দরকার হয়। এই মহকুমার মোখা অন্যান্য এলাকা থেকে কিছুটা ভিন্ন। মোখা নাচ বাদেও খন গান, জং গান, মুর্শিয়া, সত্যপীড়ের গানের পাশাপাশি মহরমের সময় হাসান-হুসেনের আÍত্যাগের বীরগাথা বাড়ি বাড়ি ঘুরে গাওয়া হয়।
অল্প কথায় বলতে গেলে বলতে হয়, ইসলামপুর মহকুমার পূজা-পার্বণ এবং লোকসংস্কৃতি যথেষ্ট সমৃদ্ধ। এখানকার সাংস্কৃতিক জগৎ নিয়ে গবেষকগণ এগিয়ে এলে খুশী হব।
ভাওয়াইয়া উৎসব স্মারক গ্রন্থ : ২০০৬, ইসলামপুর, উত্তর দিনাজপুর।