![]() |
তপন কুমার দাস মোবাইল : 94343880810 |
মনোসমীক্ষক গোববার বাবাকে গম্ভীর গলায় বললেন, আসলে ঐ পিরিয়ডটা আপনারা ইমোশনের প্রায় সবটাই খরচ করে ফেলেছিলেন। ভবিষ্যতের কোন সঞ্চয় নেই, সুতরাং নুন আনতে পান্তা তো ফুরোবেই।
গোববার বাবা খুঁতখুঁতে গলায় বললেন, তা হলে নদী সমতলে পড়া মাত্তর শাটার টেনে দিলেই তো ভাল হতো মশাই!
’তা বলতে ! মনোসমীক্ষক আকর্ন হেসে নিজেকে দেখিয়ে বললেন, অ্যাজ ফর এগ্জাম্পল– এগ্জ্যাক্টলি, আমি তো ঝর্ণাটা নিচে নাবতেই দিইনি। তার আগেই কেটে পড়েছি। এখন নতুন জীবন, নতুন মৌজ, নতুন স্বপ্ন . . . . ।
এরপর গোব্বার বাবার রিঅ্যাক্শন কী ছিল জানি না, কিন্তু আমার অদ্যপি মনে হয় নরনারীর প্রেম সময়ের প্রবল ও অখন্ড প্রবাহে কাগজের নৌকার মতই বিপজ্জনক কিন্তু আকর্ষণীয় একটা ব্যাপার।
ফ্রয়েডীয় ধারণা অনুযায়ী নরনারীর প্রেম প্রথম থেকে শেষ অব্দি একটা যৌন মীমাংসার চেষ্টাভুক্ত। এমন কী মানবীয় নন্দনতত্ত্বের গভীরে যৌন আকাঙ্খা অবগুন্ঠিতভাবে থাকে। উদার সমুদ্র ভীষণ উঁচু গম্ভীর পর্বতশ্রেণী চিরসবুজ অরণ্যানী সর্বোপরি, প্রকৃতির বিপুল নন্দন উপাদান সমূহ মানবের কাছে একঘেয়েমি যান্ত্রিক হয়ে পড়তো, যদি না তার অন্তরে বিপরীত যৌনতার শারীরীক বা মানসিক উপস্থিতি আহৃত হ’তো।
সাধের অযোধ্যা ছেড়ে বনে যাবার সময় ইক্ষাকু যুবরাজ দশরথপুত্র রামচন্দ্র চিত্রকূট পর্বতের মনোহর শৈলমালা-পরিবৃত প্রদেশে এসে বৃক্ষাশ্রায়াশ্রিত কুসুমিত লতা দেখে সীতাকে বলেছিলেন, ‘‘কি সুন্দর! তুমি পরিশ্রান্ত হইয়া যেরূপ আমাকে আশ্রয় কর, এ যেন সেই রূপ দেখা যাইতেছে।’’
সীতাও অরণ্যগমনের ও পর্বতারোহনের মহাক্লেশ ভুলে ‘কুঞ্চিত ও নিবিড় বেণী পৃষ্ঠদেশে লম্বিত করিয়া প্লিতমুখী রামচন্দ্রকে হস্ত ধরিয়া লইয়া গিয়া রক্তবর্ণ অশোকপুষ্পচয়নে নিযুক্ত করিয়া দিলেন।’
কে বলবে অরণ্যযাত্রার প্রথম রাত্রে পিতৃভক্ত এই রামচন্দ্রই অবিবেচক পিতার এহেন বোকামীতে রুষ্ট হ’য়ে লক্ষণকে বলেছিলেন, ‘‘যাহারা ধর্মত্যাগ করিয়া কামসেবা করে, তাহাদিগের দশরথ রাজার ন্যায় দুঃখ প্রাপ্তি অবশ্যম্ভাবী।’’ তার পরের দৃশ্য আরও চিত্তাকর্ষক। বনোগমনের প্রথম রাত্রি অতিবাহিত হ’লে, অরণ্যের বিপুল সুন্দর প্রাকৃতিক পুষ্পদ্যান থেকে একটা কেশরপুষ্প সীতার নিবির কুন্তলে পরিয়ে দিয়ে স্নিগ্ধ আদরে বললেন, ‘‘নাযোধ্যায়ৈ ন রাজ্যায় স্পৃহয়েয়ং ত্বয়া সহ।’’ অর্থাৎ আমি তোমার সঙ্গে বাস করিয়া অযোধ্যার রাজ্যপদ স্পৃহা করিতেছি না। –– এই হলো নরনারীর প্রেমের বিচিত্রগতি। সুতরাং মহামতি ফ্রয়েডকে অগ্রাহ্য করি কী করে ?
শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাবের আগেই বৈষ্ণব পদকর্তা চন্ডীদাস মানবীয় প্রেমের দফারফা ঠান্ডা করে তাকে নানা ভ্যানতারায় ভাববাদের সীমায় এনে ফেললেন। কৃষ্ণ আগেই ভগ্রূপে কল্পিত ছিলেন। বিষ্ণুর মর্ত্য বিগ্রহ তিনি। রাধা বিষ্ণুপ্রিয়া। চন্ডীদাস রাধাকে নিয়ে এমন ক্ষ্যাপামী শুরু করলেন যে তাঁকে সামলানো দায় হয়ে উঠলো। তার চেয়ে বিদ্যাপতির
‘এ ভরা বাদর ––মাহ ভাদর / শূন্য মন্দির মোর/ মত্ত দাদুরী –– ডাকে ডাহুকী/ ছাতি যাওত ফাটিয়া।। রসিক পাঠকের কাছে অনেক বেশী গ্রহণযোগ্য ছিল না কী ?
যুগ মনীষী প্রাজ্ঞ চৈতন্যদেব জনরঞ্জনী ব্যবস্থা সম্পর্কে সম্যক অবহিত ছিলেন। তাঁর দূরদর্শিতার প্রশংসা না করে পারা যায় না। তা না হলে কী নদীয়ার নিমাই থেকে চৈতন্যদেবের মহিমায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারতেন ? তিনি সুতনুকা ভক্তিভাবে আকৃষ্ট হলেন এবং বাংলার তাবৎ সাংস্কৃতিক জীবনকেও সেই দিকে পরিচালনা করলেন। সব যেন মাখনের মত নরম আর পেলব হয়ে উঠলো। বাঙালী ক্ষত্রিয়দের পেশী তো তেমন মজবুত কোন কালেই ছিল না। চৈতন্যের ভক্তিভাবে মিশে ডাকাতরাও লাঠি ছেড়ে সাঙাৎদের বললেন, হিরোইজমের দিন শেষরে ভায়া, এবার তোরা সবাই নিমাইয়ের নগর সংকীর্তনে চল।
সুতরাং বাঙালীর প্রেমে ক্ষাত্রধর্ম অনেক কাল আগেই বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। প্রেম সংসারের পাঁকে তার বুকে কাঁটা হয়ে শোভা পেতে লাগল। বিয়ের পাঁচ/সাত বছরের মধ্যেই পরস্পর হাই ভোল্টেজ বিদ্যুতের তার যেন, গায়ে গা ঠেকলেই বিস্ফোরণ, রক্তচক্ষুর শাসানী, দেখা আছে, সব এক গোয়ালের গরু! শুধু ঐ টুকুর জন্যই যত খাতির! হা ঈশ্বর শরীর যে প্রেমের অন্যতম উপাচার এটা কে মা দুগ্গাকে বোঝাবে। ভাগ্যিস ফ্রয়েড চাচা জন্মেছিলেন। না হলে তো ঐ ভাবের উপাসকরা দেশ-গাঁ ছাড়া করে ছাড়তো ?
শরীর মহাশয় বড়ই নিঠুর। তার বায়নাক্কার শেষ নেই। বুড়ো হাড়ে তর্জার লড়াই চলছে, কিন্তু বাবাধন ল্যাম্ফো জেলে রাত জেগে বসে রয়েছেন। কান ধরে উঠবস করালেও ফিচেল হাসে, চাবুক মারলেও বুকের কাছে ল্যাম্ফোর শিখা আড়াল করে পিঠ এগিয়ে দেয়, এমন দুর্দিনে চন্ডীদাস বড় সহায়, সুতনুকা ভক্তি তো গ্রান্ড আইডিয়া। একালের দুনিয়া কাঁপানো মনোবিদরাও বাঙালীমনের এত গভীরে ঢুকতে পারেননি।
’৪৭-এর আগে গোয়ালন্দের ঘাটে ষ্টীমার ভিড়লে বোটের পুরুষ রূদালীরা হেঁকে হেঁকে বলতো, আয়েন বাবুÑ ’ছ ’ছ আনা খাবোন ভালা– পাকা পাখানা। ভাষাতত্ত্বেব গুরুমুখীনতা এর অর্থোদ্ধার বড় দায়। প্রেমের মতো মহৎ কিছুর তৌলিকতা এটা অবশ্যই নয়, তবু দায় বড় বিষম বস্তু। একটার পর একটা কার্যকারণেই আসে। আয়ুর্বেদ শাস্ত্র নিধানে মানব শরীরে বায়ু বিকারের পরিণতি বাত-ব্যাধি। শরীর বিধানে একটা ভয়ঙ্কর বিপর্যস্ত অবস্থা। হোমিও শাস্ত্রানুযায়ী ক্রনিক প্রমেহ দোষ। এ্যালোপ্যাথরা কিছু কাল ব্যাথা নাশক বড়ি, স্টেরয়েড চালানোর পর মেথোট্রিস্কিকেট চিকিৎসার পরামর্শ দিচ্ছেন। ইদানিং ঐ তিন চিকিৎসাশাস্ত্রই কিন্তু ‘সি’-এর মাথায় অনুভূমিক দাগ কেটে ‘ক্রনিক’ লিখছেন। অর্থাৎ ব্যাপারটিকে উদ্বেগাকুল রুগীর সামনে ঘুলিয়ে দিয়ে বাঘ আর মেষ শাবকের গল্পটা বলে সান্ত্বনা দিলেন। কয়েক জেনারেশন আগে নিশ্চয় আপনার বংশের কারও এই ব্যাধি ছিল। এখন বাপ তুমি খুঁজে বের কর তাঁকে। কী হবে তাকে ঢুরে বের করে ? ভুষুকপাদ বললেন, আঁপনা মাঁসে হরিণা বৈরী।’ অর্থাৎ গোয়ালন্দ ঘাটে মুখরোচক খাবার খেয়ে তোমার নিুচাপ হবেই। তাই হোটেলের মুখতারদের হাঁক –– ‘পাকা পায়খানা।’
সুতরাং ধর্মগুরুর আপ্তবাক্য হ’ল, এ ব্যাপারে (প্রেমের) অন্তত ঐ পর্যন্ত যাওয়ার দরকার নেই। তার আগেই সন্ন্যাস নিয়ে ফেল। এই গেরুয়া বসন, দোরে দোরে মাধুকরী, নধরাদের কটাক্ষ, দিনশেষে সন্ন্যাসিনীদের নির্দায় উষ্ণ সাহচর্য– খারাপ কী ?
অতীতের রাজপুরষদের কাছে প্রেম ছিল ট্রিকস। যে সীতাকে রামচন্দ্র হরধনু ভেঙে পরশুরামের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে অর্জন করেন, যাকে চুরির অপরাধে তিনি দেবতা ও বানরদের সহযোগিতায় রাবণকে নির্বংশ করলেন, এবং সীতা চুরি যাওয়ায় বনানী কুটীরে তাঁর অদর্শনে স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল ঢুরে ফেলে দুগ্ধপোষ্য ভ্রাতার সামনে শিশুর মত আং-ফাং বলতে শুরু করলেন– সেই সীতাকেই বনগমনের প্রাক্কালে (যদি পিতা আদেশ করেন তবে) ভরতকে সোর্দপ করতে চাইলেন, বনবাস থেকে ফিরে এসে জনতার মনোরঞ্জনের জন্য জলন্ত অঙ্গারে প্রবেশ করে সতীত্বের পরীক্ষা দিতে বললেন– এসব বাঁদরামী কী সহ্য করা যায় ? সীতার পাতাল প্রবেশ তো একটা প্র্যাগমা। সীতা যে পুড়ে মরেননি তাঁর কী কোন নিশ্চিত প্রমাণ আছে ? বাল্মিকী মহাকাব্যের ট্রাজেডিটাকে এভাবেই দাঁড় করিয়েছিলেন। কাহিনীর মাদকতায় তিনি নিজেই কী সীতার পাণিপ্রার্থী ছিলেন ? রামচন্দ্রের হাত থেকে ঐ বনলতাটিকে বাঁচানোর অন্য রাস্তা সম্ভবতঃ ছিল না। এতে এক ঢিলে দুটি পাখিই মরল। সীতাকে তিনি রামচন্দ্রের হাত থেকে কেড়ে নিলেন; আর রাম ? বেচারা রাম ! অযোধ্যার ‘অবুঝ’ মানুষগুলোর চোখে সাময়িক ভাবে হিরো প্রতিপন্ন হলেও নারী নির্যাতনের দায়ে পড়লেন; কিন্তু রামায়ণের এমনই মহিমা যে রাম চরিত্রের এই অসঙ্গতিগুলোকে কেউ মনে রাখেনি। কারণ বাল্মিকী রামের যে সুউচ্চ আদর্শ রচনা করেছিলেন, তাতে তাঁর শেষ চালটি কোন কাজে লাগেনি। অবশ্য কোন মনোবিদের পরামর্শ চাওয়া হলে তিনি হয়ত বলবেন, বাল্মিকী কতৃক রামকে এত মহৎ গাম্ভীর্য দানের পেছনে অবশ্যই কিছু গূঢ় মনন উপাদান আছে। সীতা বাল্মিকীর মানস পটে আঁকা প্রেম প্রতিকৃতি বৈ তো আর কিছুই নয়। ইক্ষ¦াকু বংশের এই সামান্য কাহিনীটুকু তিনি শুনেছিলেন ত্রিকালজ্ঞ নারদের মুখে, তাকেই অসামান্য করে রামায়নের সৃষ্টি। যাই হোক, যে সীতা কবির পার্থিব কামনা বাসনা প্রেমের রসায়নে সৃষ্টি, তার জন্য প্রয়োজন যোগ্য পুরুষকার। রামচন্দ্র সেই ছায়ানট। কিন্তু সেই ছায়ানট যখন কল্পনা ও রচনা রসায়নে তাঁকেই (স্রষ্টা) অতিক্রম করে গেল তখন তার বারোটা বাজানো ছাড়া আর গতি কী! প্রথমে আÍরতির সন্তুষ্টি তারপর ধ্বংস।
॥ ২ ॥
যাই হোক, বর্তমান সমাজে পাঁচ বছরে একবার ভোট দেওয়া ছাড়া নারীর আর কোন অধিকার কার্যত আছে কিনা সে ব্যাপার আমার সন্দেহ আছে। যদি এ ব্যাপারে কারও দ্বিমত থাকে, তবে তিনি তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে, আলোচনার প্রমাণপত্রসহ পত্রিকা সম্পাদকের মারফৎ আমাকে চিঠি দিয়ে জানাবেন। আমরা আপিস কাছারিতে যে সব নারীদের দেখে স্বাধীন মনে করি সম্ভবতঃ তারা আরও পরাধীন। পুরুষেরা বসের ধমক খেয়ে বাড়ি ফিরে স্ত্রীকে বকাবকি করে অন্ততঃ মনের খেদ মেটাতে পারেন, কিন্তু নারী ? নৈব নৈব চ। তার দু’কুলই গেছে। বসের বকা খেতে হ’চ্ছে, টাকা রোজগার করতে হচ্ছে, ছেলেপুলে মানুষ করতে হচ্ছে, স্বামীর আঙ্কশায়িনী হয়ে রাত গভীর না হলে চোখের পাতা এক করতে পারছেন না, আবার পরের দিন রুজির ধকল। এই বহুবিধ ভূমিকায় সে ক্লান্ত, জর্জরিতা – তবু তাকে মুখ বন্ধ করে দিনের পর দিন এই অমানুষিক ধকল সইতে হচ্ছে। এক্শেপ্শনাল হয়ত কেউ আছেন, তবে তা সংখ্যায় নগণ্য।
পুরুষ কতৃক নারীর অধিকার হননের ইতিহাস বহু পুরোনো, আজকে ইউরোপ আমেরিকায় নারীর স্বাধীন বিচরণ দেখে এদেশের নারীরা হা-হুতাশ করেন। কিন্তু এই ভারতবর্ষেই বেদোক্ত যুগ পর্যন্ত নারীর আÍঙ্গিক ও বৈষয়িক স্বাধীনতা অক্ষুন্ন ছিল। ব্যাহ্মণ্য সংযোজন নারীকে সর্বতোভাবে গৌণ করে দেয়। কিন্তু অধিকারহানী তারও আগে শুরু হয়। আমি মনে করি খাদ্যের মতই কামনার অধিকার মানুষের মৌলিক চাহিদার অন্তর্ভূক্ত। নারী যখন পলিঅ্যান্ড্রিক ও পলেমিক ছিল তখন তার সেই অধিকার ছিল। সে ইচ্ছে মত পুরুষ সঙ্গী বেছে নিতে পারতো। এমন শত শত উদাহরণ অতীত ভারতে আছে। মহাভারতের প্রথম অংশেও এই নারীদের পাওয়া যায়। না হলে ভীষ্ম, বেদব্যাস, কর্ণ, পঞ্চপান্ডব হ’ল কী ভাবে ? পান্ডুর গোচরেই (সমর্থনেই) কুন্তি পর পর তিন জনের সঙ্গে মিলিত হন – এমন তথ্যও তো বিরল নয়। কিন্তু তার জন্য পান্ডু বা তৎকালীন সমাজ তাকে ভ্রষ্টা বলে আখ্যায়িত করেনি। সে যুগে পুরুষ নারীর পাণিপ্রার্থী হলে নারী নিজশক্তি ও অধিকার বলে শর্ত আরোপ করতেন। এ যুগে উল্টোটা হয়। পুরুষ হিসাবে আমিও হয়তো এই উল্টোটাকেই সমর্থন করবÑ কারণ এই সংস্কার আমি সমাজ থেকেই অর্জন করেছি। কিন্তু সত্য সদাই স্বাধীন। যে নারী বা পুরুষ এই সত্যের জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ আমি তাকে শ্রদ্ধা করি।
এদেশে যারা নারী স্বাধীনতার কথা বলেন, নারী প্রগতির জন্যে গলা ফাটান তারা শুধু মাত্র নারীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার কথা বলেন। নারীর যৌন স্বাধীনতার কথা বলেও বলেন না। কারণ তাঁদের প্রগতির ধারণাটাই সম্ভবতঃ ত্র“টিপূর্ণ। আবার যারা বৈদিক জীবন নিয়ে মাতামাতি করেন তারা আদৌ বৈদিক সমাজে খোলা হাওয়ার কথা বলেন না। তারা নারীকে গৃহবন্দী করে রাখতে চান, বিধবার মাথা মুড়িয়ে সন্ন্যাসিনী করতে আগ্রহী। তাঁরা ব্রাহ্মাণ্য সংযোজনগুলোকে বেদ বলে চালাতে চান।
আমি মনে করি নারীর অধিকার নিয়ে এই ভন্ডামীর অবসানে নারীদেরও সদর্থক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এটা কোন তথাকথিত দল বা সংঘের ছত্রছায়ায় সম্ভব নয়। কারণ এ-অব্দি যাবতীয় তন্ত্রের উর্দ্ধকমার অভ্যন্তরে পুরুষদের দাপট। তাছাড়া ক্ষমতার অঙ্ক যখন ভোট বাক্সের ব্যালটে নির্ধারিত হয় সেখানে নারী নেহাৎ সংখ্যামাত্র। যেহেতু তারা গণনায় কম এবং সংখ্যায় ও সমাজ জীবনে পুরুষের অধীন সুতরাং তারা মূল্যহীন, গৌণ।
আমরা নারী প্রসঙ্গে দূর অতীতে যতটা এগিয়ে ছিলাম, আজ ততটাই পিছিয়ে। অতীতে গ্রীকরা মেয়েদের লোহার কৌপিন পরিয়ে বাড়ির বাইরে যাবার অনুমতি দিত, আবার নিজেরা বাড়ির বার হ’লে গৃহাভ্যন্তরে স্থিত নারীটির প্রতি একই ব্যবস্থা নেওয়া হতো––যা আমরা আজও ভাবতে পারি না। ইউরোপের ক্যাথলিক গির্জাগুলিতে কোন পুরুষ কর্মচারী গির্জার কোন নারীর সঙ্গে মাখামাখি করলে প্রয়োজনে তার লিঙ্গ কেটে নেওয়া হ’তো। মোঘল-পাঠান সুলতান আমলে খোঁজা প্রহরীর কথা সর্বজনবিদিত।
নারীর তথাকথিত দৈহিক শুদ্ধতা বজায় রাখার এই নিষ্ঠুরতম প্রবণতা, আমি মনে করি রাজনৈতিক বা রাষ্ট্রনৈতিক ভাবে করা সম্ভব নয়। এর জন্য চাই একটা নতুন আঙ্গিকের সমাজ পুনর্গঠন। কৌমার জীবনের টোটেমীয় অন্ধ অনাচার ভীতির গরল বর্তমানে সবটাই নারীর পানপাত্রে ঢেলে দেওয়া হয়েছে। কৌমারীয় টোটেম ব্যবস্থায় কিন্তু নারী-পুরুষকে পৃথক করা হয়নি। সেখানে সমটেটেমভুক্ত নারী-পুরুষের দৈহিক সম্পর্ক অন্তরায় ছিল। কিন্তু নারীকে পৃথকভাবে দোষী করা হ’তো না। এই ট্যাবু আদিম সমাজ পেয়েছিল অজাচার ভীতিজনিত কারণ থেকে। এর উৎস আজও অজানা। তবে অনুমেয়–– ডারউইন সাহেব টোটেম নিয়মাবলী অনুমোদনের পূর্বেই বর্হিবিশ্বে এই প্রথার উল্লেখ করেছেন। তার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, ডাকাবুকো সন্তানটির প্রতি পিতার নির্দেশ আমার কাঙ্খিত স্ত্রীলোকদের প্রতি যৌন আচরণ করলে তার দন্ড অতি কঠোর হবে। সম্ভবতঃ ফ্রয়েড সাহেব একেই সন্তানের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা পিতা কতৃক পুত্রের লিঙ্গচ্ছেদের আদিম ভীতি হিসাবে উল্লেখ করেছেন। যা হোক কোন ক্ষমতাবান কৌমার পুরুষ যখন স্বীয় কৌমার এবং তদ্বংশীয় সেই কৌমার থেকে ছিটকে যাওয়া অন্যান্য অধিকতর দুর্বল কৌমারের নারীদেরও কামনা করতে শুরু করলেন এবং কোন জীবজন্তু পাখি বা প্রকৃতির নামানুষঙ্গে পরবর্তীতে কৌমার ও বংশলতিকা চিহ্নিত হ’লো তখন সেই টোটেমীয় দলগুলো একই টোটেম চিহ্নিত নারী পুরুষের বৈবাহিক সম্পর্ক (যৌন সম্পর্ক) রদ করে দিল। চালু হল বহির্বিবাহ। অর্থাৎ বহির্বিবাহ উৎপত্তির জন্য আপাতদৃষ্ঠিতে যে টোটেমীয় ট্যাবুর (ভারতীয় সমাজে গোত্র, গণ, উপাধী) কথা বলা হয়ে থাকে সেটিও মানবের যৌন আচরণের একটা ভিন্ন রূপ। যদিও অ্যান্ড্রু ল্যাং এত গভীরে না গিয়ে একে সাধারণ টোটেমীয় ট্যাবু বলেই উল্লেখ করেছেন।
ভারতীয় সমাজে টোটেমবাদের প্রবল পুনরাবৃত্তি দেখা যায় বেদের পরবর্তী যুগগুলোতে –– যখন ব্রাহ্মণ সংহিতাগুলো রচিত হতে শুরু হ’ল। প্রাণীজ টোটেমগুলোকে মুনি-ঋষির নামে আখ্যায়িত করা হল। যেমন ভরদ্বাজ গোত্রের (উপাধী –– ভট্টাচার্য্য) টোটেম ভারুই পাখী –– তিনি ঋষি ভরদ্বাজ। অন্যান্য প্রাচীণ গোত্রগুলোতে এই টোটেমীয় ব্যবস্থায় স্পষ্ট ইঙ্গিত আছে। আজও বিবাহ প্রথার মাধ্যমে নর-নারী যৌন সম্পর্ক স্থাপনের বিষয়টি এই আদিম রীতি মেনে চলে। কুল-গোত্র এক হলে বিবাহ দেওয়া হয় না। অনেকে নানাভাবে, এমন কী বায়োভ্যারাইটি সৃষ্টির স্বকোপল বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দান করেন। এক্ষেত্রে জিন বিজ্ঞানকেও টেনে আনা হয়। কিন্তু যে নৃতাত্বিক তাগিদে অর্থাৎ আদিমদের অজাচার ভীতি থেকে এটি পরুষাণুক্রমে বাহিত তা আজও দোর্দন্ডপ্রতাপ সমাজঅঙ্গে তা অধিকাংশ মানুষের দৃষ্টির অগোচরে রয়ে গেছে। দেখা যায়, বিবাহে মাতৃবংশ অচ্ছুৎ নয়, কিন্তু পিতৃবংশ নৈব নৈব চ। একি শুধু জিনগত সাদৃশ্য হেতু বিকলাঙ্গ সন্তান জন্মের ভয় (প্রচলিত আলোচনা) না আদিম পিতার আদেশ ?
টোটেমীয় সাদৃশ্য না থাকলে স্ত্রীকেও সহোদর ভ্রাতা কিংবা অন্য যে কোন পুরুষের ভোগ্য বস্তু হিসাবে তুলে দেওয়া যায়Ñ এটি প্রাচীন ভারতীয় বিধানসম্মত। রামায়ণ, মহাভারতে এই উদাহরণ বিরল নয়। রামচন্দ্র বনবাস প্রাক্কালে পিতা দশরথের ভগ্নদশা প্রত্যক্ষ করে অঘটন পটিয়সী সৎ-মা কৈকেয়ীকে সান্ত্বনা দিয়ে পিতার দুঃখ লাঘব করার জন্য বলেছিলেন পিতৃসত্য পালনের জন্য তিনি রাজৈশ্বর্য্য, রাজত্ব তো দূরের কথা প্রাণপ্রিয় সীতাকেও ভ্রাতা লক্ষণকে উৎসর্গ করতে প্রস্তুত। মহাভারতে ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠীর পাশা খেলার দান হিসাবে শেষ পর্যন্ত স্ত্রী দ্রৌপদীকেও বাজি ধরেছিলেন। একথা জানার পর দ্রৌপদী রাজঅন্তঃপুরে একজন প্রত্যক্ষদর্শিনীকে উষ্মার সঙ্গে প্রশ্ন করেন যে, তাঁকে পাশার দান হিসাবে ধরার আগে যুধিষ্ঠীর নিজেকে দান হিসাবে উৎসর্গ করেছিলেন কিনা ? তারপর দ্রৌপদীর অবস্থা তো আমাদের সকলেরই জানা !
প্রেমের একাল তুলনামূলকভাবে আরও কন্টকময়। পূর্বে সমাজজীবন, গল্প উপন্যাস, কাব্য, কবিতা থেকে প্রেমের স্থায়ী আদল পাওয়া যেত। বর্তমানে ফার্স্ট মিডিয়ার যুগে জীবনের অসীম ব্যস্ততার মধ্যে তা আর খুঁজে পাওয়া যায় না।
প্রাচীন মহাকাব্য, খন্ডকাব্য, পদাবলীকাব্য ইত্যাদি গ্রান্ড সাহিত্যগুলোতে প্রাকবৈবাহিক প্রেমের ছড়াছড়ি থাকলেও অতীতে বাস্তব জীবনে তার চল খুব বেশী ছিল না। ফলে বিবাহ নারী-পুরুষ উভয় পক্ষের কাছেই ছিল আকর্ষণীয়। নোতুন জীবনের শুরুটা কেমন হয় এই কৌতূহল রজনীগন্ধার সুবাসের মতই বিয়ের অনেক আগে থেকেই উভয় পক্ষের মধ্যে ধূমায়িত হ’তো। বর্তমান প্রজন্ম এই প্রাক বৈবাহিক মৌতাত কতটা অনুভব করে জানিনা, কিন্তু গুছিয়ে নামার চেষ্টায় তাদের বড় বেশী ব্যাকুলতা দেখা যায়। ছেলেরা যেমন সাজানো-গোছানো বাড়ি বা ফ্ল্যাটে পাটরাণী করে স্ত্রীকে ঘরে তুলতে চায়, মেয়েরাও তেমনি একটা রেডি নির্দায় ও নির্মক্ষিক সংসার চায়। শুধু আমি আর তুমি-র বিপজ্জনক মনোবৃত্তি এবং পরিজন নির্মোচনের মনোভাব যে, সময়ে কতটা হৃদয় বিদারক হতে পারে, তার নমুনা একালের অধিকাংশ শিশুর মধ্যেই প্রকটভাবে দেখা যাচ্ছে। শিশুরা কিন্তু ঘুরে ফিরে শিকড়ের অনুসন্ধান করে। পিতামাতার নিলিপ্ত উদাসীনতা তাদের আহত করে, কখনো ক্ষুব্ধ। বস্তুতঃ এই পরিবারতন্ত্রের কোরক থেকে শুরু হয় শিকড়শূন্য নির্দায় সমাজের নিঃশব্দ পদচারণা। এর বিরুদ্ধে অবশ্যই অনেক যুক্তি আছে, আছে পাশ্চাত্য সমাজের উদাহরণ–– কিন্তু ভারতীয় জীবনাচারণে, আমি কে ? কী আমার আদ্যন্ত পরিচয় ? কোথায় আমার অন্তঃপ্রবিষ্ট শিকড় ? –– এই প্রশ্নগুলি বড়ই মারাত্মক।
এ-মুহূর্তে যারা নারী প্রগতি ও স্বাধিকার আন্দোলনে রত বা রতা তাঁদের প্রতি আমার শ্রদ্ধার শেষ নেই। কিন্তু এই আন্দোলন যখন তীব্র স্বাজাত্যবোধে আÍপ্রকাশ করে তখন কিন্তু ভীষণ খারাপ লাগে। প্রশ্নটা যখন পুরুষশাসিত সমাজে নারীকে পুরুষের সমমর্যদায় দেখার দৃষ্টিভঙ্গি সংক্রান্ত, তখন নারীবাদী আন্দোলন অবশ্যই হবে ঐ দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে কিন্তু তা না হয়ে যদি মূল প্রশ্নটিকে দূরে সরিয়ে রেখে তা যদি পুরুষ জাতির বিরুদ্ধেই পরিচালিত হয় তবে তা সত্যিই দুঃখজনক।
অতীতের যে সব নারী আমাদের উজ্জীবিত করে তারা কিন্তু নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গির নিহিলিক আদর্শ থেকে বেরিয়ে এসেই নারীর মানব মহিমাকে উর্দ্ধে তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলেন। এরা স্বাধ্বী ছিলেন। তার অর্থ এই নয় যে তারা সকলেই পতিব্রতা ছিলেন। আমরা বাংলা অভিধানে দেওয়া সাধ্বীর অর্থ থেকেই সাধ্বী শব্দের অর্থভেদ করার চেষ্টা করি, কিন্তু সাধ্বী শব্দটিকে ভাঙলে দাঁড়ায় সাধু-ই। আবার ঐ অভিধানেই সাধু শব্দটির অর্থ পাবেন ধার্মিক। ধর্ম-ইক, অর্থ ‘ধৃ’ ধাতু নিষ্পন্ন ইক্ প্রত্যয় যোগে), সৎ, শিষ্ট, ভদ্র মার্জিত, উত্তম ইত্যাদি। তাহলে স্বাধ্বী শব্দের অর্থ কীভাবে সেই অভিধানেই পতিব্রতা হয় বোঝা ভার। অর্থাৎ প্রখর পুরুষতান্ত্রিক গোঁজামিল। শিক্ষা সংস্কারক ও প্রগতিবাদীরা এসব ভেবে দেখেছেন কী ? সেসব নারীদের যৌন জীবনের আখ্যান আমরা জানি। তার পুনরুক্তি না করেই বলা চলে যে, পুরাকালে স্বাধীর ব্যাখ্যাটা অন্যরকম ছিল। তারা আÍশক্তিতে বলীয়ান ছিলেন; ছিলেন ধীময়ী ও স্বাধীনচেতা।
তা হ’লে একালের নারীরা কি আÍশক্তিতে বলীয়ান নন ? নন ধীময়ী বা স্বাধীনচেতা? হয়তো অনেক বেশী। তাঁরা মহাকাশে পাড়ি দিচ্ছেন, বৈমানিক হচ্ছেন, সমুদ্র সাঁতরে এপার-ওপার হচ্ছেন, অলিম্পিকে দুরন্ত খেলে সোনা জিতছেন, লক্ষ লক্ষ ডলারের মোটর কার রেসে অংশ নিচ্ছেন, অভিনেত্রী, শিক্ষয়িত্রী, ডাক্তার, আপিস-কাছারিতে কাজ করছেন, কুস্তি বক্সিং-এ অংশ নিচ্ছেন, দেশের প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন, ইউ.এন.ও-তেও প্রতিনিধিত্ব করছেন। এই তালিকার শেষ নেই। কিন্তু এতদ্সত্ত্বেও যে প্রশ্নটি আজও পীড়া দেয় তা হলো, নারী তার জীবনাচারণে নানা দিকে প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা অর্জন করলেও, আমাদের দেশে বা অন্যান্য এশিয় ইউরেশিয় বা আফ্রিকান দেশগুলোতে সদর্থক অর্থে নারী কী স্বাধিকার অর্জনে সমর্থ হয়েছেন ? ফিরে পেয়েছেন কী অতীতের স্বাধীন যৌন-আচরণের অধিকার ?
তথাকথিত প্রগতিবাদীদের কাছে এহেন আবদার ইউটোপীয় মনে হতে পারে, কিন্তু নারীর সার্বিক বিকাশে যাজ্ঞবল্ক্যের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে আলোচনার ইতি টানছি। নারী সম্বন্ধে যাজ্ঞবল্ক্য বলেছেন, জায়া নিজের (অর্থাৎ পুরুষের) অর্ধাংশ। বিবাহ সম্প্রদানের প্রসঙ্গে বলেছেন, কে দান করেছিল ? কাকে দান করেছিল ? কাম দিয়েছেন: কামকেই দিয়েছেন। কামই দাতা, কামই প্রতিগ্রহীতা।
নারী-পুরুষের প্রেমকে যাজ্ঞবল্ক্য চূড়ান্ত মর্যাদা দিয়ে বৃহদারণ্যকোপনিষদে ব্রহ্মোপলব্ধির উপমান রূপে একে উপস্থাপিত করেছেন, যেমন––‘যেমন প্রিয় স্ত্রীর দ্বারা আলিঙ্গিত পুরুষের বাহ্যজগতের কিছুরই বোধ থাকে না, তেমনই ব্রহ্মজ্ঞান হলে বাহ্য বস্তুর– কোন বোধই থাকে না।’’
বিবর : প্রেম সংখ্যা। ২০০৫, ইসলামপুর, উত্তর দিনাজপুর।