July 28, 2014

গল্প / সুদূরের পিয়াসী / নিশিকান্ত সিন্‌হা

নিশিকান্ত সিনহা
মোবাইল : 8900676237
— কি এত ভাবছ ?
— ভাবছি সেদিনের ঘটনা, যা আমার জীবনটাকে ওলট পালট করে দিয়েছে।
— ভুলে যাও সে সব। নিজের ভাবনাচিন্তা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেবার চেষ্টা কর। মনটা ভাল থাকবে।
— তুমি ঠিকই বলছ। কিন্তু মনটা তো হাতের মুঠোয় থাকে না, থাকে বুকের নিভৃত কোণে। প্রান্তিক তিস্তার হাতটা নিজের বুকে নিয়ে বলল, তুমি তো মনটাকে নিয়ে গেছ, ফিরিয়ে দাও।

প্রান্তিকের বুকে নিজের হাতটা সরিয়ে নিতে গিয়েও সরাতে পারল না। বুকের ধুক্ ধুক্ শব্দে তার সর্বাঙ্গে এক ভাল লাগার অনুভূতি ঘুরে-ফিরে বেড়াচ্ছে। তার ইচ্ছা করছিল প্রান্তিকের বুকে নিজেকে সঁপে দেয়। সবকিছু উজার করে দেয়। পারে না। শুধু ফিসফিস্ করে বলল, এভাবে কতদিন চলবে ? এর পরিণামই বা কী ?

— তোমার সাথে এভাবে মিলিত হওয়াটাই তো বিধির ইচ্ছা। নইলে তোমাকে পাব, স্বপ্নের অতীত। বিধাতা যখন আমাদের কাছে এনেছে তখন পরিণামের কথাও ভেবে রেখেছেন।
না প্রান্তিক। পরিণাম না ভেবে কাজ করা অসমীচীন। বিধাতার দোহাই দিয়ে সবকিছু করা যায় না। তুমি কি ঠিক করলে ?
— সবকিছুই তো ঠিক আছে। পুজোর আগেই তুমি চিরদিনের জন্য আমার হচ্ছো। প্রান্তিক তিস্তার মুখে ভালবাসার চিহ্ন এঁকে দিতে যায়। তিস্তা দূরে সরে গিয়ে বলল, এসব ডায়লগ অনেক পুরোনো। নতুন কিছু বল।
— তাহলে এক্ষুণি ম্যারেজ রেজিষ্ট্রারের কাছে চল। সই-সাবুদ করে আসি। যাবে ?
— না . . . তা বলছি না। অপ্রস্তত তিস্তা। নিজেকে সামলে নেয়। প্রান্তিকের কথায় এমন প্রত্যয় ছিল যে তিস্তা অবিশ্বাসের সীমানায় দাঁড়াল না।

কিছুক্ষণ আগেও প্রান্তিক এই ঘরে ছিল। যতক্ষণ ছিল, ততক্ষণ তিস্তার হুঁশ ছিল না। সে অপলক দেখছিল প্রান্তিককে। যতই দেখে আশ মেটে না। ওর চেহারা তেমন আহামরি বা রূপোলি জগতের কোন হিরোর মত নয়। খুব সাদা সাপ্টা। লাজুক গোছের। তবুও তার দুই ঠোঁটের শব্দহীন হাসি, ব্যক্তিত্বময় পুরষালি গড়ন আর মার্জিত কথাবার্তায় তিস্তা কুপোকাৎ। অভিভূত। পুরুষের শরীরের  আলাদা একটা গন্ধ থাকে যার সুবাসে নারীর বুক আনমনে দোলা খায় এক অদ্ভুত আনন্দে যা ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না।

প্রান্তিক অনেকক্ষণ আগে চলে গেছে। সে চলে গেলেও যেন রেখে গেছে তার গোটা    অস্তিত্ব যা উপলব্ধি করে তিস্তার প্রতিটি রোমকূপে ঝড় উঠেছে। তার গায়ের গন্ধ, চুলের গন্ধ, সিগারেটের পোড়া কটূ গন্ধ— সব মিলিয়ে এক নেশা করা ভারী বাতাস তিস্তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। কল্পনার জগতে সবাই কি তার মত এমন উপলব্ধি পায়, যেমন সে পাচ্ছে ? নিজেকে প্রশ্ন করে তিস্তা। এই পাওয়া না পাওয়ার মধ্যে পূর্ণতা, অপূর্ণতার কোন সামঞ্জস্য না থাকলেও যা সে অনুভব করতে পারছে সেটাই বা কম কীসে!

তিস্তা অনিচ্ছায় বিছানা ছেড়ে ওঠে। আয়নায় নিজেকে খুঁটিয়ে দেখে। আড়মোড়া ভেঙে একটা হাই তোলে। হাই তোলার সময় মুখটা বিরাট লাল গহ্বরের মতন দেখাল।  সে দেখে। আয়নায় নিজের ঐ মুখ দেখে আচমকা হেসে ফেলে।
দুই কামরার ছোট্ট ফ্ল্যাট। এটাচ্ড বাথ, কিচেন এবং একফালি গ্রীল বিহীন দক্ষিণমুখো ব্যালকনি। সেকেন্ড ফ্লোরের এই ফ্ল্যাটটি তার নিজস্ব। অনারশিপ ফ্ল্যাট। মার্বেল, টাইলস্ আর অত্যাধুনিক ডিজাইনের প্লাসটিক পেইন্ট করা একটা স্বয়ং সম্পূর্ণ ফ্ল্যাট মনের মতো সাজানো। শিলিগুড়ির বুকে অভিজাত পাড়ায় এর গুরুত্বই আলাদা। কিন্তু বড্ড একা।

তিস্তা অফিসে যায়। কাজকর্ম করে এবং সন্ধ্যের আগে সিটি বাস ধরে ফিরে আসে তার নিজস্ব ঘরে। অফিসটা একটু দূরে। সেবক রোড ধরে আকাশবাণী ভবন ছাড়িয়ে অনেকটা দূরে। আধা সরকারী অফিসের মাইনে করা পারসোন্যাল আ্যসিসট্যান্ট সে। সিনিয়র পারসোনাল অফিসারের সহকারী। গোটা উত্তরবঙ্গের ছয়টি জেলা তো বটেই, সিকিম, ভূটান সহ নানা রকম বাণিজ্যিক তথ্য ও তার হিসাবে তাকে রাখতে হয়। তার ঘরের কম্প্যুটার যাবতীয় ডাটা বাক্সবন্দী। ফাইল নম্বরের বোতাম টিপলেই পর্দায় ভেসে ওঠে প্রয়োজনীয় তথ্য।

কিন্তু একঘেয়েমী কাজের মধ্যে সে কোন আনন্দ খুঁজে পায় না। নেই জব স্যাটিসফেকশন্। ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় তার মনে মাল্টিমিডিয়ার একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ সংস্থা খোলার স্বপ্ন জিইয়ে রেখেছিল। স্বাধীনভাবে নিজের চিন্তাধারার প্রসার ঘটিয়ে উত্তরবঙ্গে এমন একটা দৃষ্টান্ত রাখা যায় মার্কেটিং-এর জন্য স্পনসরেরা তার দুয়ারে ধর্না দেবেন।
কিন্তু স্বপ্ন স্বপ্নই। রয়ে গেছে মনের ছোট্ট এক নিভৃত কোণে। স্বপ্ন পূরণের চেষ্টা সফল হয়নি বলেই তাকে এস.পি.ও-র সহকারী হতে হয়েছে। কোথাও ভাল অফার পেলে ছেড়ে দেবে।

পুজোর বেশি দেরি নেই। কিন্তু এরই মধ্যে বঙ্গোপসাগরে নিুচাপের দরুন উত্তরবঙ্গে যে ঝড়ের তান্ডব হয়ে গেল তাতে অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়ে গেছে তাদের সংস্থার। বিভিন্ন জেলা থেকে এস.ও.এস ক্রমাগত আসছে। কাজের চাপও অত্যাধিক। বড়, মেজো, মাঝারি ও ছোট সাহেবদের জরুরী মিটিং ও তাদের এমারজেন্সি ট্যুর তিস্তার পুজো বাজারের চিন্তা মাথায় উঠেছে।
ঘরময় পায়চারি করতে করতে  ব্যালকনিতে দাঁড়ায় তিস্তা। ফেলে আসা স্মৃতির কোণায় সে শহরটাকে খুঁটিয়ে দেখে। আলো ঝলমল গোটা শহর যেন শারদোৎসবে মেতেছে। যেন তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে— চলে এসো তিস্তা।  অপ্রয়োজনীয় যতসব অফিসিয়াল চিন্তা ভাবনা ঝেড়ে ফেলে নেমে এসো নীচে। তোমার স্বপ্ন, ইচ্ছাপূরণের এমন সুযোগ আর পাবে না কোনদিন। কই, এসো! হঠাৎ মোবাইলের রিং টোনের শব্দে সম্বিৎ ফিরে পায়। মেসেজের সংকেত। বোতাম টিপে পড়ে— অ্যারাইভিং সানডে প্রান্তিক।

প্রান্তিক আসছে। তিস্তার বুকে অবিরাম ঝড়।  কিছুক্ষণ আগে হয়ে যাওয়া ঝড়ের মত। যে ঝড়ে ভেসে গেছে অনেক পরিবার, মানুষজন, ঘরবাড়ি। কিন্তু তিস্তার বুকের ঝড় সর্বগ্রাসী বিধ্বংসী নয় বরং এই ঝড় অনাগত ভবিষ্যৎ নির্মাণের। তিস্তার অনেক আশা, আকাঙ্খা আর স্বপ্ন পূরণের।

রবিবারের সাত-সকাল থেকে তিস্তা ঘর গোছাতে ব্যস্ত। বিছানা, বালিশে নতুন কভার, ফুলদানিতে ফুল আর জানালায় নতুন পর্দা লাগায়। রজনীগন্ধার স্টিকে ভর্তি ফুলদানি রাখে জানালার পাশে। ঘরে ঢুকেই যাতে প্রান্তিকের চোখে পড়ে। প্রান্তিক রজনীগন্ধা ভীষণ ভালবাসে। এক নজর ঘরের ভিতরটা দেখে নিয়ে তৃপ্ত হয়। রুমফ্রেসার স্প্রে করে ব্যালকনিতে দাঁড়ায় তিস্তা। ওর পড়নে হাল্কা  আকাশী রঙের সিফন জর্জেট। ম্যাচিং ব্লাউজ। গলায় হীরের লকেট দেওয়া সোনার সরু চেন। নিজেকে মোহময়ী করে তুলে প্রান্তিককে ভাসিয়ে দেবে তিস্তা। ঠিক ভরা বর্ষার তিস্তা নদীর  স্নিগ্ধ উচ্ছ্বলতা যেন।
ডোর বেল বাজতেই তিস্তা ত্রস্ত পায়ে দরজা খোলে। সামনেই প্রান্তিক। বাঁধনহারা কাল্পনিক সুখের স্পষ্ট চিহ্ন তিস্তার গোটা মুখে, সারা অঙ্গে।
— আমি এসে গেছি।
— তা তো দেখতেই পাচ্ছি।
— তবে একা নয়। সঙ্গে আরেকজন আছে। ডাক দেয় প্রান্তিক। কেকা এসো।
দরজার আড়াল থেকে সলজ্জ একটা মুখ উঁকি দিল। দু’হাত জোড় করে বলল, নমস্কার। আমি কেকা।
তিস্তার কপালে ভাঁজ। কেকা ? কে হয় প্রান্তিকের ? কি সম্পর্ক ওর সাথে। ওর তো এখানে একা আসার কথা ছিল। আড় চোখে কেকার সর্বাঙ্গ জরিপ করে নিয়ে বলল, তোমরা একটু বস। আমি এক্ষুনি আসছি।
প্রান্তিক পথ আগলায়।

— আমাদের জন্য কিচ্ছু করতে হবে না। এক্ষুনি চলে যেতে হবে। দার্জিলিং মেলের টিকিট কাটা আছে। এন.জি.পি-তে তাড়াতাড়ি না পৌঁছাতে পারলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। কথা বলা শেষ হলে তিস্তা লক্ষ করল প্রান্তিক যেন কিছু লুকোচ্ছে। যেন পালাতে পারলে বাঁচে। কেকার পরিচয় ও দিল না।

— এক কাপ চা না দিলে কেকাই বা কি ভাববে।
— না না আমরা চা খেয়েই এসেছি। জলপাইগুড়ি থেকে বাসে রওনা হয়ে শিলিগুড়িতে নেমেই খেয়েছি। কি গো, বলনা!
— হ্যাঁ হ্যাঁ, খেয়ে-ই এসেছি। প্রান্তিক অপ্রস্তুত। আমতা আমতা করে বলল, তার চেয়ে জরুরী খুব তাড়াতাড়ি কলকাতা পৌঁছনো। ওর বাবা এক নার্সিং হোমের ইনটেনসিভ কেয়ারে ভর্তি রয়েছে। তিস্তা প্লিজ, কিছু মনে কোরো না। আমরা এক্ষুনি রওনা হচ্ছি।

তিস্তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ওরা দ্রুতবেগে চলে গেল। ভেঙে পড়ল তিস্তা। প্রান্তিকের সন্দেহজনক আচরণে মর্মাহত। তার সাজসজ্জা, সুখ সাগরে ভেসে যাওয়ার স্বপ্নভঙ্গ তাকে বিধ্বস্ত করে দিল মুহূর্তেই।

হঠাৎ লোডসেডিং। রাতের অন্ধকারে তাকে ক্রমশ গ্রাস করতে লাগল। নিজেকে কোন মতে সামলে এক ঝট্কায় সোফা ছেড়ে উঠে পড়ল তিস্তা। এখনও ভেসে যায়নি। অবয়বহীন এই অন্ধকার তাকে মুছে ফেলতেই হবে। শক্ত করে মোবাইল ফোন তুলে প্রান্তিককে বলল, জাস্ট ওয়েট প্রান্তিক। আমিও রওনা হচ্ছি। আমি না যাওয়া পর্যন্ত ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা কর তোমরা।

দ্রুত রাস্তায় নেমে পড়ল তিস্তা। তক্ষুনি আলো ঝলমল হয়ে ওঠল গোটা শহর। মনে মনে বলল, অপ্রয়োজনীয় অফিসিয়াল যাবতীয় চিন্তাভাবনা ঝেড়ে ফেলে নেমে পড়েছি। এবার স্বপ্ন পূরণের পালা। একটা অটোয় নিজেকে ঠেলে দিয়ে ড্রাইভারকে বলল, এন.জি.পি চল ভাই— খুব  জল্দি। যা ভাড়া লাগবে তার চেয়ে বেশি দেব। দার্জিলিং মেল ধরিয়ে দিতে হবে। তিস্তা সীটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করল।

প্রকাশকাল : ২০০৪। বিবর সাহিত্য পত্রিকা–২০০৪, উৎসব সংখ্যা । ইসলামপুর