প্রেম
শব্দ এক অসাধারণ শব্দ। সাধারণ অর্থে অতি সাধারণ অর্থ দাঁড়ায়। ব্যপক অর্থে দাঁড়ায় অসাধারণ
অর্থ। ব্যাপক অর্থে প্রেম সর্বব্যক্তিতে, সর্ববস্তুতে, এমনকি সাধারণ দৃষ্টির
বাইরে যা, তাতেও প্রেম হ’তে পারে।
প্রেম শব্দ বিশেষভাবে নর-নারীতে চিহ্নিত।
তাই প্রেম নিয়ে যে আলোচনাই করা যাক, নরনারী স্বাভাবিক ভাবেই এসে পড়ে। প্রেম শব্দ
শুনলেই যেন এক অলৌকিক ভাব এসে পড়ে। বস্তুতঃ লৌকিক ভাব এর সাথে থাকে এক বাস্তবতা,
এক স্থূলতা, পাশাপাশি অলৌকিক ভাব এর সাথে থাকে এক অবাস্তবতা এক সুক্ষ্মতা।
এই সুক্ষ্ম নিবিড় ভাবই আমাদের নিয়ে যায় এক
অন্য জগতে যে জগতে একজন বলতে পারে আমি সুখী। সুখ শান্তি দাঁড়িয়ে থাকে প্রেমে। প্রেম
সেখানে অগ্নিশিখা।
‘‘ধার্মিকের ঈশ্বরকে ভালোবাসা আর প্রেমিকের
কোন নারীকে ভালোবাসা এক জিনিস নয়। কিন্তু এদের মধ্যে একটা বিষয়ে বেশ মিল আছে। সে মিল
একটা বোধের একটা আবেগের। প্রেমিক প্রেমিকার কাছে যে তীব্র আকাঙ্খা নিয়ে ছুটে আসে আকাঙ্খার
সে তীব্রতাই ধার্মিককে টেনে আনে ঈশ্বর সান্নিধ্যে’’ দূর থেকে নিকটে আসা, নিকট থেকে নিজেকে বিলিয়ে
দেওয়া। অন্ধকার থেকে আলোতে আসা তারপর একসময় আলোতেই মিশে যাওয়া। প্রেমেই যেন এটা সম্ভব,
অন্যভাবে নয়। কোন বস্তুকে স্থির বিশ্বাসে অবলম্বন করলে সে বস্তুই যেন প্রাণময় হয়ে
ওঠে। ব্যক্তিতে গেলেও তাই। অলৌকিক ভাব-এ অবস্থান করলেও তাই। সবকিছুতেই যেন এক থেকে
দুই তারপর আবার এক।
নদীর পরিণাম যেমন সমুদ্র, সবার সবকিছুর পরিণাম তেমন প্রেম। এই পরিণামের জন্য নদীকে হতে হয় গতিময় মানুষকেও হতে হয় জ্ঞানী। হতে হয় সহজ-সৎ-সরল, পবিত্র। ভালো শব্দের সাথে ঘটাতে হয় গভীর পরিচয়। সোলোভিয়েক বলেছেন,— যে বেদীতে ব্যক্তি তার অহংকে বলি দেয় সে বেদীই ভালোবাসার বেদী’। এদিক থেকে বলা যায় ভালোবাসা হ’ল আÍ অবলুপ্তি বিলিয়ে দেওয়া। ওরটেগা ওয়হি গ্যামেট-এর ‘অন লাভ’ প্রবন্ধের পুস্তক অনুসারে বলা যায়— ‘‘ ভালোবাসা হল একটা বন্যা, মানুষের ব্যক্তিত্বের অন্তিম গভীর থেকে তা উৎসারিত হয়ে জীবনকে কাণায় কাণায় ভরে দেয়।
নদীর পরিণাম যেমন সমুদ্র, সবার সবকিছুর পরিণাম তেমন প্রেম। এই পরিণামের জন্য নদীকে হতে হয় গতিময় মানুষকেও হতে হয় জ্ঞানী। হতে হয় সহজ-সৎ-সরল, পবিত্র। ভালো শব্দের সাথে ঘটাতে হয় গভীর পরিচয়। সোলোভিয়েক বলেছেন,— যে বেদীতে ব্যক্তি তার অহংকে বলি দেয় সে বেদীই ভালোবাসার বেদী’। এদিক থেকে বলা যায় ভালোবাসা হ’ল আÍ অবলুপ্তি বিলিয়ে দেওয়া। ওরটেগা ওয়হি গ্যামেট-এর ‘অন লাভ’ প্রবন্ধের পুস্তক অনুসারে বলা যায়— ‘‘ ভালোবাসা হল একটা বন্যা, মানুষের ব্যক্তিত্বের অন্তিম গভীর থেকে তা উৎসারিত হয়ে জীবনকে কাণায় কাণায় ভরে দেয়।
প্রেমিক-প্রেমিকা ব্যক্তিসত্তার এমন গভীর
স্তরে নিবদ্ধ দৃষ্টি হয়ে থাকে যে, সত্তার জাগরণ ও উৎকর্ষ তাই যেন বিবেচ্য অন্য যা কিছু সবই বাহ্য।
একজনের চোখে সে তেমন সুন্দরী নয়, অন্য জনের চোখে সেই পরমা সুন্দরী। অন্যজনের চোখে সে অতি কুৎসিত।
আসলে, অন্তরের অন্তঃস্থলে চলতে থাকে অনুসন্ধান, চলতে থাকে আশ্রয়ের
সন্ধান। কারণ প্রেমই দিতে পারে আশ্রয়। সভ্যতার শুরুতেও আশ্রয়ই ছিল বড় কথা আজও তাই।
চিত্তের নানান বিকারের বিনাশ শুধু প্রেমে। প্রেমহীন সবই শুষ্ক রসহীন প্রাণহীন। প্রেমই
পারে সবাইকে আÍবিকাশের পথে নিয়ে যেতে। বিকাশই জীবনের ধর্ম। প্রেমহীনতাতেই স্তব্ধ
হয়ে যায় জীবনের বিকাশ। প্রকাশে বিকাশে ছন্দময় জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে প্রেম না হলে সবই অর্থহীন কখনো বা জড়বৎ মৃতবৎ।
প্রেম হঠাৎ আলোর ঝলকানি নয়। আলেয়া নয়। পরস্পরের
ক্রম উন্মোচন। হৃদয়বৃত্তির ও বুদ্ধিবৃত্তির এক স্বীয় মিশ্রিতফল যেখানে থাকে চলনে,
বলনে, মননে এক সঠিক পথের ঠিকানা। প্রেম দেবে স্থিরতা, দেবে আশা, ভাষা, প্রেম যেন অন্ধজনে
চক্ষুষ্মান। দুটি আÍার একাÍকরণ।
‘‘লোকে বলে ভালোবাসা অন্ধ। মিথ্যা কথা বলে।
আসলে কামনা অন্ধ, ভালোবাসা নয়, ভালোবাসা জ্ঞানাঞ্জন শলাকার মতন। অন্ধকেও
বরং সে চক্ষুদান করে।’’ (যজ্ঞেশ্বর রায়)
সময় এগিয়ে চলে, শেষ হয় না,
মানুষ শেষ হয় নির্দিষ্ট সময়েই। এই অনন্ত সময়ে যুগে যুগে কালে কালে প্রেমকে দেখা
হয়েছে নানা ভাবে আনা হয়েছে নানা অভিধায়, প্রেম তবু প্রেমই থেকে গেছে। যুগে যুগে কালে
কালে, প্রেম আসলে কী ? জিজ্ঞাসুরা উত্তর খুঁজেছেন সোচ্চার হয়েছেন সাহিত্যে সংগীতে চিত্রে
নানা উত্তরে। প্রেমকে জানার মধ্যেই যেন বেঁচে থাকা। প্রেমের স্বরূপ জানা যেন এক দুরুহ
সাধনার সিদ্ধি, সে সিদ্ধিকে অনেকে ঈশ্বর সিদ্ধির কাছে নিয়ে যান। তাঁরা বলেন,
‘প্রেমই ঈশ্বর’। আমরা সাধারণ মানুষরা এতটা ভাবতে পারব না, বলতে পারব না বুঝতেও
পারব না, তবে এই জগৎ ও জীবকে
নিয়েই যে প্রেম সেটা বুঝি। আর বুঝি প্রেমই শক্তি, প্রেমই বুদ্ধি,
প্রেমই ভক্তি। প্রেমই সার, আর সব অসার।
––––––––––––––––––––––
বিবর, এপ্রিল ২০০৫
No comments:
Post a Comment