September 6, 2014

গল্প / আস্তাকুঁড় / চোমংলামা

রাস্তার পাশেই দোতলা বাড়ি

কিন্তু বাড়িটা এমন যে বাড়ির লোক জন সবাই সামনের ঘরখানা দিয়ে ঢুকে দোতলাসহ বাড়ির সর্বত্র যাতায়াত করে। কেউ ঘুরে গিয়ে মেন গেট দিয়ে যাতায়াত করে না। সামনের যে ঘরখানা দিয়ে সবাই যাওয়া আসা করে সে ঘরখানায় কার্তিক আর কর্তা বাবু থাকে। কর্তা বাবুর দুই ছেলে তাদের বউ ছেলে মেয়ে সব দোতলায় থাকে। ছোট ছেলে প্রতুলের অবশ্য ছেলেমেয়ে নেই। স্বামী আর স্ত্রী। দোতলার আর একটা ঘরে থাকে কর্তাবাবু মেয়ে শিবানী। একাও থাকে আবার কখনও কখনও দোকাও থাকে। কর্তাাবাবুর প্রচুর বয়স হয়ে গিয়েছে। কার্তিক জানে না কর্তা বাবুর বয়স কত হল। ছেলেরা, ছেলের বউরা কেউ বলে ছিয়ানব্বই, কেউ বলে সাতানব্বই। আটানব্বইও হতে পারে। কর্তাবাবুর জ্ঞান গম্যি কিছু নেই বললেই চলে। কয় ছেলেমেয়ে কি তাদের নাম, সব ভুল হয়ে গিয়েছে। তবে কার্তিক-এর নামটা মনে রাখতে পারেন। স্ত্রী মনোরমা বহুকাল আগে গত হয়েছে। কার্তিক গিন্নী ঠাকরুনকে দেখেনি। তার এমন জ্ঞান গম্যি শূন্য অথর্ব মানুষকে ছেলে বা ছেলের বউদের সব সময়ে দেখাশোনা করা সম্ভব নয় বলে সর্বক্ষণের জন্য কার্তিককে রেখে দেওয়া হয়েছে।


কার্তিক তার সাধ্য মত সেবা যতè করে কর্তাবাবুকে। টাকা নিয়ে কাজ করছে বলে কাজে ফাঁকি দেয় না। সকালে উঠে হাত ধরে বাথরুমে নিয়ে গিয়ে ধুইয়ে মুছিয়ে, জলখাবার খাইয় কাপড় জামা পরিয়ে ফিটফাট করে বারান্দায় গ্রীলের পাশে গদি আঁটা ইজিচেয়ারে বসিয়ে দিয়ে যায়। কর্তাবাবু তার ঘোলাটে চোখের দৃষ্টি মেলে রাস্তার লোকজনের যাতায়াত দেখেন। রিকশা, অটো গাড়ি দেখেন।

আর দেখেন তার ঠিক সামনেই ফুটপাথের উপর বসিয়ে রাখা ডাস্টবিনটা।
কর্তাবাবু দেখেন, আশপাশের বাড়ি, সামনের রাস্তার ওপাশের বাড়িার লোকজন, মেয়েরা ঝুড়ি ভর্তি ময়লা নিয়ে আসে আর ডাস্টবিন-এ ফেলে দিয়ে চলে যায়।
কর্তাবাবু ডাকেন কার্তিক।
এজ্ঞে কর্তাবাবু আমাকে ডাকছ ?
কর্তাবাবু বলেন লোকে এখানে ময়লা ফেলে কেন রে ?

কার্তিক বলল তুমি হাসালে কর্তাবাবু। লোকে এখানে ময়লা ফেলবে না তো কোথায় ফেলবে ? এটাই তো ময়লা ফেলার পাতর। ডাস্টবিন। ভুলে গেলে কর্তাবাবু ?
কর্তাবাবু আবার জিজ্ঞেস করেন এটা পরিস্কার করে কারা ? কবে পরিস্কার করবে ?
ও সব পরিস্কার করার নোক আছে কর্তাবাবু। ওদের সময় হলেই ওরা সাফ সাফাই করতে আসবে। তুমি ব্যস্ত হয়ো না কর্তাবাবু। কর্তা বাবুর বড় মেয়ে শিবানী সাজগোজ আর প্রসাধন করে ভ্যনিটি ব্যাগ নিয়ে বাবার পাশ কাটিয়ে বারান্দা দিয়ে গিয়ে রাস্তার নামল।
ও কে গেল রে কার্তিক ?

কার্তিক বলল ওকে চিনতে পারলে না কর্তা বাবু ? ও তোমার মেয়ে শিবানী গো!
তা ও এখানে কেন ? আমি তো ওর বিয়ে দিয়েছিলাম কর্তাবাবু জিজ্ঞাসা করলেন। কার্তিক  কর্তাবাবুর ইজি চেয়ারের পাশে উবু হয়ে বসে কানে কানে মুখ নিয়ে ফিস্ ফিস্ করে বলল সে বিয়ের কপালে তেঁতুল গুলে দিয়ে কবেই সে বর ঘর সংসার ছেড়ে দিয়েছে। এখন নাইট কেলাবে যায়। বেহদ্দ মাতাল হয়ে মাঝ রাতে বাড়ি ফেরে। মাঝে মাঝে নাং  ধরে নিয়ে এসে বাড়িতেই বেলেল্লাপনা করে। কেউ কিছু বলার নেই তো !  কার্তিক কর্তাবাবুর ধুতি জামা গেঞ্জী বারান্দার গ্রীলে মেলে দিতে দিতে নিজের মনেই গজ গ্ করতে থাকে। বলেতোমাদের ভদ্দর লোকদের ঘরের কেলেংকারী হল ফ্যাশন। হত আমাদের ছোট নোকদের ঘরে এতক্ষণ চতুর্দিকে ধিৎকার পড়ে যেত।

কর্তাবাবু বললেন ওই ডাস্টবিনটা পরিস্কার করার জন্য লোকজন কবে আসবে রে কার্তিক?
আসবে আসবে কার্তিক বলল তুমি ব্যস্ত হলে চলবে কেন ? ওই ডাস্টবিন ময়লাতে ভরে যাবে। ময়লা চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়বে। তারপর তো ওরা আসবে। লোকজন আসবে, গাড়িতে ময়লা তুলে নেবে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ময়লা তুলে নিয়ে ওই জায়গাটা ঝাঁট দিয়ে পরিস্কার করে দিয়ে যাবে। তুমি কিছু ভেব না কর্তা বাবু। কর্তা বাবু হয়তো আশ্বস্ত হন। ঘোলাটে চোখের দৃষ্টি মেলে কি দেখেন তিনি তা কার্তিক বুঝতে পারে না।
কয়েকদিন পরের কথাই হবে কর্তাবাবু ইজিচেয়ারে বসে ছিলেন। এমন সময় কর্তাবাবুর বড় আর ছোট ছেলের বউ, বড় ছেলের কলেজে পড়া শ্রাবণীকে দুজনে দুদিক দিয়ে আস্তে আস্তে পা ফেলে কর্তাবাবুর পাশ কাটিয়ে বাড়ির অন্দর মহলে চলে গেল।

কর্তাবাবু বললেন ওরা কারা গেল রে কার্তিক। কার্তিক তেমনিভাবে কর্তাবাবুর ইজিচেয়ারের পাশে উবু হয়ে বসে ফিসফিস করে বললতোমার ছেলে ভোপেনবাবু তাঁর ছোট ছেলে নেপেন বাবুর বউ গো!
ও কাকে ধরে ধরে নিয়ে গেল ? ও কে ? ও কি অসুস্থ ? ওর কি হয়েছে ?
কার্তিক বলল ওর কি হয়নি বলো !  নিমুনিয়া, টাইফটর, সর্দিগর্মি সব হয়েছে।
কার্তিক আরও বলল কাকে ধরে ধরে নিয়ে গেল, ও তোমার বড় ছেলে ভোপেন বাবুর মেয়ে ছেরাবনী গো। কলেজে পড়ত। পড়ত তো ওর গুস্টির মাথা। পড়তে পড়তে গব্ববতী হয়ে পড়েছে। চার মাসের পোয়াতি। মা আর কাকী নার্সিং হোমে নিয়ে গিয়ে খালাস করে নিয়ে এল।

কর্তা বাবু বললেন কোন অসুবিধা হয়নি তো ? পোয়াতি আর বাচ্চা ভাল আছে তো ?
পোড়া কপাল আমার কার্তিক বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়াল।
এতক্ষণ শুনলে কি ?
কর্তাবাবু বললেন হ্যা রে, আজও তো ডাস্টবিন পরিস্কার করার জন্য কোনও লোক জন  এল না!
আসবে আসবে কর্তাবাবু, ওরা ঠিকই আসবে। কার্তিক বলল আগে ডাস্টবিন ভরে উঠুক ময়লাতে, চারদিকে ছড়িয়ে ছড়িয়ে ছিরিখেওর হয়ে যাক্ তারপর ওরা আসবে। তুমি কিছু ভেবনি।
প্রথম রাত্রেই বিছানার পরে উঠে বসে কর্তা বাবু ডাকলেন কার্তিক।
কার্তিক মেঝেতে বিছানা পেতে শুয়েছিল।  তবে ঘুমায়নি। কার্তিক উঠে বসল।
কি হয়েছে কর্তা বাবু ? বিছানা ভিজিয়ে ফেলেছ ?
না , কর্তাবাবু বললেন দ্যাখ আমার হাতের এই খানটায় খুব ব্যথা হচ্ছে। যন্ত্রণায় শুতে পারছিনে।  কর্তা বাবু তার কাঁধ আর বাহুসন্ধির স্থানটা দেখিয়ে দিলেন।
কার্তিক ব্যথার জায়গাটা হাত দিয়ে চমকে উঠল এ কি তোমার তো জ্বর হয়েছে ?
জ্বর হয়েছে ? তা হবে হয়তো।

কার্তিক বলল তুমি একটু কষ্ট করে শোও কর্তাবাবু। আমি দোতলায় যাচ্ছি দেখি কারও কাছে আয়োডেক্স আছে কিনা। মালিশ করে সেঁকে দিয়ে দিলে আরাম হবে। কার্তিক দোতলায় উঠে গেল। কর্তা বাবুর বড় ছেলে ভুপেন শুয়ে শুয়ে ঘুম জড়ানো গলায় বলল আমার কাছে ও ওষুধটা নেই রে কার্তিক। নৃপেেেনর কাছে আছে নাকি দ্যাখ্ তো।
আজ্ঞে ওদের ঘরে তালা দেওয়া। কেউ ঘরে নেই।

ভুপেন শুয়ে শুয়ে বলল নাইট ক্লাবে গিয়েছে। ওদের কাছে খুঁজে লাভ নেই। ফিরবে তো দুজনে বেহ্ডে মাতাল হয়ে। শিবানীর কাছে দেখতে পারিস।
শিবানী কর্তা বাবুর একমাত্র মেয়ে। স্বামী আর স্বামীর ঘর ছেড়ে দিয়ে এখন বাপের বাড়িতে থাকে।  বাপের বাড়ি আছে কিন্তু ভালোভাবে নেই। রাত একটু বেশি হলেই এক একটা অচেনা পুরুষ নিয়ে মেন গেট দিয়ে বাড়িতে আসে। সারা রাত ধরে মদ খায় আর বেলেল্লাপনা করে । লোকটা ভোর বেলার দিকে চলে যায়।
শিবানীর ঘরের দিকে এগুতে গিয়ে ঈষৎ ফাঁক জানালার কাছে দাড়িয়ে পড়ল কার্তিক।

রাম-রাম-রাম!!!
রাম নাম স্মরণ করল কার্তিক। বিছানার উপরে শিবানীর আর একটা অচেনা মানুষ। দুজনের গায়ে কাপড় চোপড় বলতে কিছু নেই। লোকটা শিবানীর খোলামেলা শরীর নিয়ে ভীষণভাবে হাতড়াচ্ছে।
আয়োডেক্স পাওয়া গেল না। কার্তিক বলল কি আর করব কর্তাবাবু। হ্যারিকেন জ্বেলে তোমার হাতে সেঁকে দিয়ে দিই। বিছানার পরে উঠে বসতে গিয়েই কার্তিক থমকে গেল। কর্তাবাবু কাপড় চোপড় বিছানার চাদর ভিজিয়ে বসে শুয়ে আছেন সেই ভিজে বিছানার পরে। কার্তিক বলল হা কপাল। এখন এত রাতে কি করি বলো তো ?

কার্তিক কর্তাবাবুর কাপড় গেঞ্জি খুলে সম্পূর্ণ উলঙ্গ করে ঘরের মেঝেতে দাড় করিয়ে দিয়ে তোষক উলটে, নতুন একটা চাদর পেতে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে লেগে গেল।
আর এমনি সময়ে বারান্দার তালা দেওয়া গেট-এ প্রবল ঝাঁকানির শব্দ আর জড়ানো কন্ঠে চিৎকার কার্তিক, দরজা খোল্ বাবা। আমরা এসেছি। ঘরে ঢুকব বাপ্।

কর্তাবাবুর ছোট ছেলে নৃপেন আর তার বউ নাইট ক্লাব থেকে মদ খেয়ে টং হয়ে বাড়ি ফিরল। দুজনের কারও পা ঠিক মত পড়ছে না। দুজনেই ঘরের মধ্যে এসে কর্তাবাবুকে বিবস্ত্র অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ছোট বউ জড়িয়ে বলল যাঃ বাবা। এটা নাইট ক্লাবের ডার্ক রুম নাকি। তা ওনার বেড পার্টনার কই ?
নৃপেনও  তেমনি জড়িয়ে জড়িয়ে বলল ওর বেড পার্টনার অনেক দিন হল ফুটে গিয়েছেন ডার্লিং। কিন্তু আজ রাতে তোমার বেড পার্টনার কে ছিল কান্তা ?
কান্তা বলল তুমি জানো না। ভেরি হ্যান্ডসাম চার্মিং ইয়ংম্যান মিস্টার মজুমদার।
তাই নাকি ?

পরদিন দুপুরে ভূপেন আর নৃপেন দুজনে খাওয়ার টেবিলে বসে ভাত খাচ্ছে, এমনি সময়ে কার্তিক গিয়ে সামনে দাঁড়াল। কার্তিক বলল বড় বাবু, ছোট বাবু, তোমাদের বাবার গতিক কিন্তু সুবিধের নয়। কাল সন্ধ্যায় জ্বর হয়েছিল। সকাল থেকে হুঁস আসছে আর যাচ্ছে। ডাক্তার দেখাতে হলে এখনই ব্যবস্থা করো।
তুই যা, আমরা খেয়ে নিয়ে যাচ্ছি।
ওরা দু-ভাই খাওয়া শেষ করে বাবার শিয়রে দাঁড়াল।
দুজনেই ডাকল বাবা- বাবা।
কোন সাড়া নেই।

অবস্থা বিশেষ ভাল না। তুই ডাক্তার বোসকে একটা কল্ দিয়ে আয় নৃপেন।
সন্ধ্যার মুখে ডাক্তার এলে বড় বউ, ছোট বউ মেয়ে শিবানী এবং নাতনী শ্রাবনীও নেমে এল কর্তাবাবুর ঘরে। ডাক্তার বেশ ভাল করে দেখলেন।
বড় ছেলে বললকি রকম দেখলেন ? নার্সিং হোমে নিয়ে যাব ?
ডাক্তার বোস বললেন কি হবে টানা-হ্যাচড়া করে। আর কিছু করার নেই। লেট হিম ডাই পিসফুলি। ডাক্তার চলে গেলেন।
সন্ধ্যা হল। কর্তাবাবু দুই চোখ মেলে বড় বড় করে এদিক ওদিক তাকালেন।
কার্তিক ওর মুখের কাছে কান নিয়ে বলল কিছু বলবে কর্তাবাবু ?
কেউ কর্তাবাবুর গলার স্বর শুনতে পেল না। কিন্তু কার্তিক ঠিক বুঝে নিল। তার কর্তাবাবুর কথার জবাবও দিল।

তুমি কিছু ভেব না কর্তাবাবু। ওরা ঠিক আসবে। ওদের আসার সময় হয়ে গিয়েছে। এইবার ওরা এসে পড়বে। বড় ছেলে জিজ্ঞাসা করল কারা আসবে রে কার্তিক ?
কার্তিক বলে আছে। সে তোমরা বুছবে না।

কর্তাবাবুর অতীন্দ্রিয় চেতনা তখন পার্থিব আলো ছেড়ে এক অলৌকিক আলোর ঝরনার মধ্যে বিচরণ করছিল। আর সেই আলোর ভিতর দিয়ে আপাদমস্তক সাদা পোষাক পরা কয়েকজন মানুষ এগিয়ে আসছে। তাদের হাতে ঝাড়ু কোদাল বেলচা। খুব নিশ্চিন্তভাবে চোখ বন্ধ করলেন কর্তাবাবু।

––––––––––––––––––
কালিনী, জানুয়ারী ২০১০

No comments: