September 2, 2014

গল্প / প্রহরী / তপন কুমার দাস

খবরটা অনাদিই মনিলালের কানে দিয়ে গেল।
সেই অব্দি মনিলাল গম্ভীর। উপর থেকে খুব একটা কিছু বোঝা না গেলেও, আপাততঃ মনিলালের আচরণে কিছু পরিবর্তন অদূরবর্তিনী অহল্যাকে চিন্তিত করল।
মনিলাল যে সে লোক নয়। হাজারিবাগ শহরের এক সময়ের সবচেয়ে প্রভাবশালী জমিদার রঙ্গলাল চৌধুরীর সর্বশেষ উত্তরাধিকারী। স্থানীয় লোক তাঁকে রাজাবাবু বলে ডাকে, আবার আড়ালে অতীতের বৈভব ও গৌরব খোয়ানো এই দাম্ভিক মানুষটাকে নিয়ে রঙ্গরসিকতাও করে। সংসারে বর্তমানে একটি বিবাহযোগ্য, শিক্ষিতা মেয়ে ও স্ত্রী ছাড়া তিনি প্রায় নিঃসঙ্গই বলা চলে।

সেই মনিলাল চৌধুরী অর্থাৎ রাজাবাবু আপাততঃ ওর কয়েকপুরুষ পূর্বের তৈরী বৃক্ষ শোভিত বিশাল হাওদাওয়ালা বাড়ির দোতলার ঝুল বারান্দায় কতগুলো মেহগিনি কাঠের অ্যান্টিক চেয়ার দিয়ে নিপুণভাবে ঘেরা একটা বিশাল শ্বেত পাথরের টেবিল থেকে কিছুটা তফাতে লম্বা হাতল ওয়ালা আর্মচেয়ারে বসে অষ্টাদশ শতাব্দীর বাংলার ইতিহাস সংক্রান্ত একটা প্রাচীন ও প্রামাণ্য গ্রন্থ পাঠ করছিলেন। তার পায়ের কাছে একটা সূক্ষ্ম কাঠের কাজ করা মালরী টী-পয়।  তার উপর রাখা কিছুক্ষণ আগে নিঃশেষিত হওয়া চায়ের বাহারী কাপ প্লেট, রূপোর সিগার কেস, সোনার জলে মিনে করা সিগার লাইটার, কয়েক-তা সাদা কাগজ, একটা মেটলি বডি ইঙ্ক্ পেন, নেমপ্যাড, লেটার প্যাড, কালি শোষণের জন্য সুদৃশ্য কাঠের হাতলওয়ালা ব্লটিং হোল্ডার, হাতির দাঁতের চাকু, পিঠ চুলকোনোর জন্য হাড়ের হাত নখ, হরিশের সংগ্রহ করে আনা দাঁত খুঁচানোর জন্য একগুচ্ছ নিমের কাঠি ইত্যাদি।

মনিলাল ইতিমধ্যেই হস্তধৃত ইতিহাস বইটা পেজ মার্কিং করে টেবিলের উপর রেখেছিলেন। এখন ওর চোখ দূরের আকাশের দিকে মেলা। বিকেলের এক ফালি হলদে রোদ এসে পড়েছে পাথরের ঠান্ডা টেবিলটার উপর। বাতাসে সামান্য শীত ভাব। তবে এটাই ধীরে ধীরে সময়ের সঙ্গে বাড়বে। তখন অহল্যা কিংবা একমাত্র মেয়ে এষা এসে তাঁকে ন্যাপথলিনের হালকা গন্ধে ভরা একটা শাল দিয়ে যাবে।

পশ্চিমের এই দীর্ঘ করিডোরওআলা বারান্দা থেকে বিকেলের সূর্যাস্তটা বেশ উপভোগ করা যায়। রাঙা বেকাবির বত নিরুত্তাপ সূর্যটা প্রথমে দূরের পাহাড়ে কিছুক্ষণের জন্যে যেন নিশ্চল থাকে, পরে হঠাৎই অদৃশ্য হয়ে যায়।
অন্ধকার যে ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে আসছে মনিলাল বুঝতে পারেন। মাথার উপর গোলাকার প্রাচীন অলিন্দে কয়েকটা অভিবাসী চড়–ই উষ্ণতা পেয়ে আরামের শব্দ তুলতে শুরু করেছে।
এবার মনিলাল বাহির থেকে মুখ ফিরিয়ে অদূরে দাঁড়ানো স্ত্রী অহল্যর দিকে চেয়ে ইঙ্গিত করলেন। অহল্যা ধীর পদক্ষেপে সামনে এগিয়ে এলেন। অহল্যার হাঁটা, চাহনি, বিনম্রভাবের মধ্যেও মনিলালের প্রভুত্ব যেন ঠিক্রে বেরুতে লাগল।

অহল্যা মনিলালের স্ত্রী হলেও, মনিলালের সঙ্গে ওঁর পার্থক্য অনেক। যে সম্পর্ক স্বামী-স্ত্রী মধ্যে ঘনিষ্টতা আনে, অহল্যার নিস্পৃহ ভাব ও উদাসীনতায় তা অনেককাল আগেই নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। ফলে দু’জনের মধ্যে নাম সম্পর্কের কঙ্কালটা ছাড়া বাকী কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। তবু ওরা পারস্পরিক বন্ধুত্বের আপাত মধ্য একটা সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারত যদি মনিলালের প্রকৃতিটা অত উগ্র ও কঠিন না হ’ত।
অহল্যা অনাদির বলার ধরণ দেখেই বুঝে নিল ব্যাপারটা কী হ’তে পারে। ও মনিলালের কাছ থেকে সামান্য তফাতে দাঁড়িয়ে অনুচ্চ গলায় বলল,— ‘হয়ত ভাববে অনাদি এসে যা বলে গেল তার সবটাই আমি জানি, বা জেনে বুঝেই এষাকে প্রশ্রয় দিয়েছি। কিন্তু বিশ্বাস কর, এষা কখনোই আর দশটা মেয়ের মত মায়ের কাছে বাইরের কিছুই বলে না। ও তোমার মতই চাপা . . . , একগুঁয়ে প্রকৃতির . . . ।
মনিলাল পূর্ণ চোখে স্ত্রীর দিকে তাকালেন। পরে চোখ থেকে ভারী চশমাটা নাবিয়ে সামনের টী-পয়ে চেয়ে দৃঢ় গলায় বলল,— আমি দীপ্যর বাপ আদিনাথকে জিজ্ঞেস করব— এসবের অর্থ কী! আদিনাথ কী ভেবেছে ? ছেলে ডাক্তারি পাশ করলেই আমরা মেয়ে বিয়ে দেবার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ব’ ? তা ছাড়া এষা  ওর নিজের বিয়ের ব্যাপারে ওকে রাস্তাঘাটে কী ওপিনিয়ন দেবে ? যত্ত সব নন্সেন্স।
অহল্যার স্বামীর কথার পিঠে কথা বলতে গিয়ে সামান্য ইতস্ততঃ করে বলল,— যা হবার তা তো হয়েই গেছে। আমার মনে হয় এ ব্যাপারে আদিনাথকে তেমন গুরুত্ব না দেওয়াই ভাল। তাতে ওর দাম বাড়বে। বরং অনাদিকে দিয়ে ওকে খবর দিয়ে দাও যে আমরা এখনই এসব কিছু ভাবছি না। তাতে আদিনাথ উদ্বেগ ভরে দম ধরে থাকবে, আবার ছেলেটিও হাতছাড়া হবে না। মনিলাল বিরক্তভরে স্ত্রীর দিকে চেয়ে একটা সিগারে অগ্নি সংযোগ করল। নাক মুখ দিয়ে সংযতভাবে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল, তুমি সব ব্যাপারেই কম্প্রোমাইজিং। স্লো মোশন্।  অহল্যা অপ্রস্তুতভাবে স্বামীর দিকে তাকাল। পরে  সামনের দেওয়ালে দৃষ্টি স্থির করল। বাল্বের অনুজ্জ্বল আলোয় ওদের অপার্থিব ছায়া দুটোকে যেন ওর বিগত শতকের কোন আদিমানবের ছায়ার মত মনে হ’ল। সেই ছায়া মানবের অক্ষম হাতটা বার কয়েক খুব অসহায় ভাবে ঠোঁটের কাছে এল, তারপর ইতস্ততঃ ভাঙ্তে ভাঙ্তে ফের স্বস্থানে ফিরে গেল।
মনিলাল কাশল। পুনরায় বার দুয়েক গলা খেঁকারি দিয়ে বলল,— আসলে . . ., আদিনাথের ছেলে দীপ্যকে আমারও অপছন্দ নয়। বেশ ভদ্র, বিনয়ী, স্বল্পবাকও বটে। কিন্তু আদিনাথ ? একটা এক্সক্লুসিভলি ইডিয়ট! আই নেভার টলারেট হিম।

অহল্যাকে চিন্তিত  দেখাল। মনিলালের মন রাখার জন্য আপাততঃ বিয়ের প্রস্তাব খারিজ করে অনাদিকে দিয়ে আদিনাথকে খবর পাঠানোর কথা বললেও মনটা কিন্তু সর্বদা বিপরীত ভাবনাতেই চালিত হচ্ছিল। এর সম্ভাব্য কারণ একাধিক। প্রথমতঃ ওদের আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে বাইরের লোকের বিরাট কিছু ধারণা থাকলেও ও জানে এর সিকি ভাগও এখন অবশিষ্ট নেই। তাছাড়া আদিনাথ একটু ওরকম হলেও সদ্বংশ, ইদানিং ব্যবসা করে প্রচুর টাকা করেছে; এবং দীপ্য ওর একমাত্র সন্তান। কৃতী, বিনয়ী, ভদ্র। এষার সঙ্গে মেলামেশাও সেই বাল্য বয়েস থেকে। কাস্টের বাধাটুকুও নেই বাধা বলতে স্বামী মনিলালের বংশ গৌরব, বনেদীআনা— যা যুগোপযোগী নয়। বংশ গৌরবের অভিমান পুষে ছেলে মেয়ের ভবিষ্যত নষ্ট করার কোন মানেই হয় না।
অহল্যা পুনরায় একবার তাঁর স্বামীর দিকে, একবার ওঁর ক্লিষ্ট ছায়ার দিকে, একবার আধো অন্ধকারে ঢাকা প্রশস্ত দেওয়ালের ধাতব নিস্তব্ধতার দিকে চাইল। দেওয়ালে সার দিয়ে টাঙানো মনিলালের পূর্বপুরুষের ছবিগুলো যেন অদ্ভুত এক কৌতুহলে অহল্যার দিকে চেয়ে হাসছে। অহল্যার অন্তরাÍা যেন সহসা এক অস্থির আবেগে চঞ্চল হয়ে উঠল।


॥ ২
হয়ত  এ পর্যন্ত যা হয়েছিল তা অনায়াসেই মিটে যেত, কিন্তু এর মধ্যে একদিন আদিনাথ মনিলালকে আনুষ্ঠানিকভাবে এষার সঙ্গে পুত্রের বিয়ের প্রস্তাব দিতে এসে সব গোলমাল করে ফেলল।
আদিনাথ : আমার মনে হয় ওদের বিবাহের ব্যাপারটা পাকা করে ফেলাই ভাল।  . . . কী বলেন ?
মনিলাল : আপনার সঙ্গে তো এ ব্যাপারে আমার কোন দিন-ই কোন কথা হয়নি আদিনাথ। অথচ আপনি এমন ভাবে বলছেন  . . .
— বলছি। তার  যথেষ্ট কারণ আছে। আদিনাথ অহেতুক দৃঢ় হওয়ার চেষ্টা করল।
— কী কারণ ? মনিলাল ঈষৎ উষ্মার গলায় বলল।
— ছেলেমেয়েদের ব্যাপার মশায়! সেসব আমরা অত শত বুঝব কী করে ? আদিনাথ মনিলালকে জড়িয়ে নিয়ে বিজ্ঞের মত বলল।
‘মশায়’ কথাটা যেন আদিনাথকে তীরের মত বিঁধল। এ পর্যন্ত হাজারিবাগের কেউ তাকে মশায় সম্বোধন করার সাহস পায়নি। অথচ এই আদিনাথ যে দুদিন আগেও একটা সামান্য ব্যবসায়ী ছিল, সে কিনা তাকে মশায় ডাকে ? কী ভেবেছে ও নিজেকে ? দুটো পয়সা হলেই হ’ল ? ছেলেকে ডাক্তারী পাশ করালেই হ’ল ? চৌধুরী বংশের সিংহ দরজা থেকেই যাদের একসময় বিদায় নিতে হত আজ কিনা সে চৌধুরী পরিবারের অন্দর মহলে ঢুকে আজে-বাজে কথা বলে পার পেয়ে যাচ্ছে ? অধিকারের সীমা অতিক্রম করার এই সাহস পেল কোথায় ?
মনিলাল যেন পাথরের চোখ দিয়ে আদিনাথকে পর্যবেক্ষণ করল।

ইতিমধ্যে অহল্যা চা দিয়ে গেছে আদিনাথ আর মনিলালকে। আদিনাথ আয়েস করে চা’-এ চুমুক দিল। মনিলাল কিন্তু চা স্পর্শ পর্যন্ত করল না। আদিনাথের সঙ্গে একত্র চা পারেন এ মুহূর্তেও মনের কাছে সম্মতি পেল না।
— কী মশায় চা-টা ছুঁয়েও দেখলেন না যে ? বেয়ানের হাতের চা—, আহা! মধু যেন! কী, ইদানিং বেয়ানের হাতের চায়ে রুচি নেই বুঝি ? আদিনাথ নিজের রসিকতায় নিজেই যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
আবার মশায় ! বেয়ান! কী শুরু করল এসব আদিনাথ ? আস্পর্ধা তো কম নয়! আদিনাথের কপালের ভাঁজগুলে দৃঢ় হল। রাগে ওর গা রিরি করছিল।
তবু যথা সম্ভব নিজেকে সামলে নিয়ে মনিলাল একটা সিগার ধরানোর কথা ভাবল, কিন্তু পাছে আদিনাথও এ ব্যাপারে উৎসাহিত হয়, তা ভেবে সে ইচ্ছা বাতিল করে গম্ভীর স্ফীত চোখে বাইরের দিকে তাকাল।

আদিনাথ পুরোনো কথার খেই ধরে বলল, আমি কিন্তু মা লক্ষ্মীকে পুত্র-বধূ করার    প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলাম।
— বিয়ের প্রস্তাব! এভাবে একবস্ত্রে আড়ম্বরহীন ভাবে বিয়ের প্রস্তাব আনা যায় ?  মনিলাল লোকটার নির্বুদ্ধিতায় হতবাক হয়ে ওর দিকে বিস্ফারিত চোখে চাইল। এষা ওর একমাত্র মেয়ে এখনও যা আছে তাতে এষার বিয়ের আনুষ্ঠানিক জাঁকজমকের কোন ত্র“টি হবে না। এ মুহূর্তে ওর নিজের বিয়ের আগে-পরের অনুষ্ঠানগুলোর কথাও মনে হ’ল।  সানাইয়ের শব্দ, আলোর চেক্নাই আর আÍীয় স্বজন ও খিদমতদারদের কোালাহলে তখন চৌধুরী বাড়ির দমফাটা অবস্থা যেন!  অহল্যার বাড়ি থেকে বিয়ের প্রস্তাব দিতে এসেছিল জুড়ি গাড়ি চেপে— পেছনে কলের গাড়িতে ছিল প্রাথমিক প্রস্তাবের সৌজন্যে আনা উপঢৌকন সমূহ। এখন ছেলের বাড়ি থেকেই মেয়ে বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব আনা হচ্ছে। তবু খালি হাতে! হ্যাংলামির সীমা নেই!
মনিলাল বিনা বাক্য ব্যয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে পদক্ষেপে লম্বা কড়িডোর ধরে সোজা ওর ঘরের দিকে রওনা দিল।
আদিনাথ ভেবেছিল মনিলাল হয়ত স্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করার জন্য ঘরের দিকে রওনা হলেন। কিন্তু কিছু সময় কেটে যাওয়ার পরও যখন ওদিক থেকে কোন সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না তখন আদিনাথ অনোন্যপায় হয়ে মনে মনে মনিলালের এই রূঢ় আচরণের প্রতিশোধ নিবে ভেবে চৌধুরী বাড়ি ত্যাগ করল।


॥ ৩
এষা অনতিদূরের পাহাড়গুলের দিকে তাকাল। পাহাড়ের গায়ে বড় বড় শাল, পিয়াশাল, মহুয়া, জারুল আর খয়েরের জঙ্গল। মাথার উপর বড় বড় মেঘের খন্ড ঘোরাফেরা করছে। নিচে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে চিরিমিরি নদী। কোথা থেকে একঝাঁক টিয়া উড়ে এসে দূরের একটা গাছের মাথায় ঝপাঝপ্ বসল।
ওরা একটা বেশ বড় সর হরীতকী গাছের নিচে বসেছিল। সামনেই চিরিমিরির বেলাভূমি। নামেই নদী। চতুর্দিকে ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত পাথরের খন্ডাহারের উপর দিয়ে দ্রুত ধাবমান সামান্য একটা জলধারা। কাকের চোখের মত স্বচ্ছ জল। মৌরলা মাছের ঝাঁক, পাথরের খাঁজে খাঁজে আটকানো সবুজ ঘাস, অর্কিডের মাথা ছুঁয়ে ছুঁয়ে তিরতির করে বইছে।
এষা একটা ছোট্ট নুড়ি পাথর কুড়িয়ে নিয়ে নদীর বুকে শশব্যস্ত মৌরালার ঝাঁকটার দিকে ছুঁড়ে মারতে মারতে পাশে উপবিষ্ট দীপ্যকে কৌতুকের গলায় বলল, এবার দেখ মাছগুলো কেমন এদিক-ওদিক ছড়িয়ে পড়বে!
পরিহাসের ছলে বলল, অন্যের ঘর ভাঙ্ছ? এবার যে নিজেরাই ভেঙে যেতে চলেছি! . . . এষা আমার কিন্তু মনে হচ্ছে ব্যাপারটা খুব কমপ্লিকেটেড হয়ে গেল।
এষা পায়ের কাছে তির্যকভাবে পড়া একফালি রোদ আঁচল দিয়ে ঢাকতে ঢাকতে বলল, হলে আর উপায় বা কী! বাড়িতে আমার বাবার উপর আর কারোরই কথা চলে না। এ নিয়ে মা সমস্ত সময় অশান্তিতে, ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকেন। . . . তবে এষা একটু ভেবে যোগ করল, তোমার বাবা সেদিন রাস্তায় আমাকে ওভাবে জিজ্ঞেস না করলেই পারতেন। অনাদি কাকা সঙ্গে ছিল। পুরো ব্যপারটাই বাবার কানে তুলে দিয়েছে।
— অনাদি কাকা তো তোমাদের আশ্রিত। সে ঐ ঝামেলার মধ্যে গেল কেন ? অন্ততঃ আগে তোমার মার কাছে জেনে নিতে পারত। দীপ্য ক্ষুন্ন হ’ল।
— তা হলে তো ব্যাপারটা মিটেই যেত। মা অনাদি কাকাকে মুখ খুলতে বারণ করে দিতেন। এত জলঘোলা হত না।
দীপ্য ক্লিষ্ট হাসল। একটা সিগারেট ধরিয়ে উড়নচন্ডে হাওয়ায় ধুয়ো ছড়িয়ে বলল, আসলে বাবা অত ভেবেচিন্তে কোনদিনই কথা বলেন না। আবেগতাড়িত লোক। যা মনে আসে না বলা পর্যন্ত শান্তি পায় না। . . . . তাছাড়া আমি তো ব্যাপারটার মধ্যে তেমন অস্বাভাবিক কিছু দেখছি না। তোমাকে বাবা নিজের মেয়ে বলেই মনে করেন। হাজারিবাগের এ তল্লাটের সবাই আমাদের সম্পর্কের কথা জানে। অনাদি কাকাও নিশ্চয় জানে। এই অনাদি কাকাই আমাকে তোমাদের বাড়ির সামনে বড় রাস্তার ও পাড়ে প্রিচার্ড সাহেবের গল্ফ ক্লাবের মাঠে বসিয়ে কত মজার মজার গল্প বলত।

দীপ্য দুঃখিত চোখে এষার দিকে তাকাল। ওর তারুণ্য দীপ্ত মুখে বিকেলের রোদ। চোখের কোণে বালির বিন্দুর মত অশ্র“ কণা। গাঢ় গলায় পুনর্বার বলল, আসলে বাবা ভাবতেই পারেননি যে ঐ সামান্য ব্যাপারটা তোমাদের বনেদীআনায় এভাবে আঘাত করবে।
এষা ক্লিষ্ট হাসল। স্বগতভাবে বলল, বনেদীআনা ? এক সময় ছিল। হাতি ঘোড়া, পাইক, বরকন্দাজ সবই ছিল। এখন সব ফাঁকা। গোলাপ বাগে এখন চৌধুরী বংশের কঙ্কালটা দাঁড়িয়ে আছে শুধু। পরে সামান্য থেমে বলল, আসলে, আমার বাবা ঐ কঙ্কালটা আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাইছেন। এই-ই হয়ত অতীতের অনিবার্যতা। বেভুল মানুষের ভাগ্যলিপিও বলতে পার।
এষা এবার সেই শুকনো পাতাটাকে নদীর দিকে হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে বলল,  ভাল লাগে না। কিছুই ভাল লাগে না। বনেদীআনা এখন আমাদের জীবনে অভিশাপের মত, কিন্তু কে বোঝাবে বাবাকে এসব ? বাবা অনড়। আমাদের বাড়িটার-ই মত। কত কী পাল্টে গেল, অথচ চৌধুরী বাড়িটা এখনও কেমন ত্রিশূলের মত দাঁড়িয়ে আছে!

এষা এক পলক দূরের ম্লান বৈকালিক চরাচরের দিকে তাকাল। পাহাড়ের মাথায় ঘন হয়ে জমে থাকা মেঘগুলো যেন ধীরে ধীরে ওদের দিকেই এগিয়ে আসছে। একটা পানকৌড়ি চিরিমিরি নদীর জলে পাখা ঝাপট্ েযেন বিকেলের সূর্যের দিকে উড়ে গেল।
দীপ্য চৌধুরীদের অনেক কথা-ই জানে। তবু এমন পরিবেশে এষার ঐ প্রগাঢ় বেদনা যেন ওকে কিছু সময়ের জন্য স্তব্ধ করে দিল। পরে সামান্য ইতস্ততঃ করে বলল, এই ভীষণ অতীতের কোন সমাধান আছে বলে আমার মনে হয় না। তবু আমি নিজে একবার কাকাবাবুর কাছে গিয়ে আমার দাবী জানাব। জানি না কি হবে !

এষা দীপ্যর হাত চেপে ধরল। চোখে জল। সামান্য উষ্মার গলায় তীক্ষè গলায় বলল, না, কক্ষনো না। বাবা তাঁর অতীতকে কোন মূল্যেই বিসর্জন দেবেন না। সেখানে তিনি অদ্ভুতভাবে অন্ধ। বিবেকহীন। কিভাবে রিঅ্যাকশন করবেন বলা মুশকিল। আমার মা, যে লোকটার সঙ্গে সারাজীবন কাটাল, যৌবনের সঙ্গিনী হ’ল, এই পৌঢ়ত্বে পৌঁছে এখনও দাসীর মত পরিচর্যা করে যাচ্ছে— সেও জানেনা তাঁর মনের কথা।  . . .সুতরাং অযথা কেন অপমানিত হবে তার কাছে গিয়ে ?

দীপ্য হতাশার শ্বাস ছাড়ল। সামান্য ক্ষোভ, উষ্মার গলায় বলল, তা হলে তো আর কোন উপায়-ই নেই। সব দরজা নিপাটভাবে বন্ধ। তাছাড়া, দীপ্যকে সামান্য উত্তেজিত দেখাল, বাবা গতকাল সম্ভবতঃ কিছুটা অপমানিত হয়ে তোমাদের বাড়ি থেকে ফিরে এসেছেন। খুব গম্ভীর দেখলাম। বাবাকে এ-অব্দি কোনদিনই গম্ভীর দেখিনি। ভয়ঙ্কর অভাবের দিনেও তিনি হেসেছেন। ইয়ার্কি-ফাজলামি করেছেন। কাল তোমাদের বাড়ি থেকে ফিরে এসে এ পর্যন্ত সে সম্পর্কে আর একটা শব্দও উচ্চারণ করেননি। অথচ ঐ লোকই কাল সকাল পর্যন্ত চৌধুরী বাড়ির মেয়ের শ্বশুর হবে বলে উত্তেজনায় টগ্বগ্ করে ফুট্ছিল।
এষা দীপ্যর জানুতে হাত রাখল। সমুখের চিরিমিরি নদীতে সহসা জলের উচ্ছ্বাস ভাঙ্ল। কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে নাকি ? এষা আসন্ন আঁধারের আগে অস্তগামী সূর্যের ছটায় ভাস্বর আকাশের দিকে তাকাল। মেঘ, রৌদ্র, আলো, কুয়াশা, অস্ফুট অন্ধকার মিলে অদ্ভুত এক সান্ত্র বিষন্নতা যেন ওকে ধীরে-ধীরে, পলকে-পলকে গ্রাস করে নিচ্ছিল। এষা ওর গন্ডদেশ বেয়ে ধেয়ে আসা জলের ধারা দুটিকে পুনরায় দুচোখে ফিরিয়ে নেবার জন্য যতটা সম্ভব পিছন দিকে মাথাটা হেলিয়ে হরীতকী গাছের এলোমেলো পাতার ফাঁক দিয়ে আসন্ন  আঁধারে ঢাকা আকাশ দেখার চেষ্টা করল।

-------------------------------------
বিবর, উৎসব সংখ্যা ২০০৪

No comments: