অগোছালো নরম স্মৃতির গভীরে জেগে উঠতে থাকে,
জন্ম নিতে থাকে সোনালী কিছু মুহূর্ত। আর উড়ে যায় ধুলোর মত অনেক কিছু যা একদিন প্রিয়
ছিল। মুছে যাবার আগে আবছা বেদনাবোধ জাগিয়ে তোলে হৃদয়ে। মনের অতলে ও হৃদয়ের স্পর্শে
গড়ে তোলে দুঃখবোধের এক নির্মাণশিল্প। এই দুঃখের কাছে অনির্বাণের চিরকালের ঋণ। এর মধ্যেই
অনির্বাণ এক নিজস্ব জগৎ গড়ে তুলেছে। কাউকে টের পেতে দেয় না এই একাকী দুঃখবোধের জগৎ।
এ তার নিজস্ব একক নির্মাণ। একক আহ্লাদ।
অনির্বাণ প্রাচীন টেলিফোন পোষ্টটির আশ্রয়
তারটির গায়ে আয়েশ করে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। এখানে
তার সারাদিনের ক্লান্তি ঝড়ে যায়। সে ভাবতে থাকে — এই বয়ে বেড়ানো জীবনে
সে কি পেয়েছে! এই জীবনের মানে কি ? অপেক্ষায় থাকতে থাকতে নিজের স্বপক্ষে ও বিপক্ষে কতকগুলি যুক্তি
দাঁড় করিয়ে খেলতে থাকে। কিছুটা মেলে। কিছুটা
মেলে না। কখনো উৎসাহিত হয়। কখনো মনে হয় উপড়ে ফেলি এই জগতের সব। সবকিছু। আবার
প্রথম থেকে সাজিয়ে সুন্দরতর করে গড়ে তুলবে এই পৃথিবী। এই ভাবনা অনির্বাণকে দ্বিধার
মধ্যে রাখে সর্বক্ষণ। কিন্তু এই দ্বিধা ভেঙে কোন পথ তৈরী হয় না।
তারে হেলান দিয়ে সূর্যের দ্রুত ডুবে যাওয়া
দেখতে থাকে। এই বুড়ো সূর্যটা নতুন উদ্ভাসে আবার ক্লান্তিহীন জেগে উঠবে! অনির্বাণ এই ভেবে নিজেকে উৎসাহিত করে। কিন্তু পথ
পায় না।
অনির্বাণের মনে পড়ে শুভ-র কথা। একদিন যাকে
ভালোবেসেছিল। এই ভালোবাসায় শুভ-র হাস্যময় সম্মতি ছিল কিন্তু প্রশ্রয় ছিল না। অনির্বাণ
তা চায়নিও বটে। তবু সে বর্ণময় প্রেমের স্মৃতি
অনির্বাণকে ঠেলে নিয়ে যায় আগামী কোন উৎসের দিকে।
জল আছে, নদী নেই। এমন এক তৃপ্তি
ও অতৃপ্তির জগতে সে আছে জলের মতো ।
‘শুভ ভালো থেকো’ —মনে মনে প্রার্থনা
করে অনির্বাণ।
বাস চলে আসে। হুড়োহুড়ি করে সবার প্রথমে ওঠে।
কোনদিন বা সবশেষে। ছাতা সেলাই করা লোকটিরও শেষে। এ তার খেয়াল। নিজেকে বাজিয়ে দেখার,
মিলিয়ে নেওয়ার উৎসাহ। সামনের ফাঁকা সীট
এড়িয়ে অনির্বাণ বসে পেছন সারির ডান দিকের জানালায়। হাত বাড়িয়ে দিলে স্পর্শ পাবে উল্টো
দিক থেকে ছুটে আসা দুরন্ত বাসের। অস্তগামী সূর্য দিনের শেষ অভিবাদন জানায়। বিস্তীর্ণ
সোনালী ধানক্ষেতের ওপার থেকে।
যে নারী স্বপ্নের ভেতর প্রিয়। যাকে জয় করে
অনির্বাণ রোজ। সাদা ঘুড়ির উপর চাপিয়ে রোজ যাকে আপন করে সে এসে আজ তাকে কতটুকু
ভালোবাসা মাখিয়ে গেল ? তাদের যৌথ শিউয়ে যেন বেজে ওঠে একা টেলিফোন। শুভপ্রিয়া চলে যায়।
অনির্বাণের সাথে তার ভাব ঠিক ততটুকুই যতটুকু আড়ি। এই বুঝি প্রেমের নিবিড়তম আস্বাদ।
‘যতদিন যাবে তত আমারা পূর্বপুরুষের পাপ থেকে
মুক্ত হব।’ কোথায় যেন পড়েছিল অনির্বাণ। কিন্তু মনে মনে ভীষণ ধিক্কার দিয়ে
ওঠে উক্তিটিকে।
আমরা মুছে দিচ্ছি পূর্বপুরুষের শেষ পূণ্য
অর্জন। এভাবে ডুবে যাবে আমাদের আধুনিক সভ্যতা। তার চেয়ে ভালো ছিল বনজঙ্গল, অসভ্য বসবাস। অনির্বাণ
নিজের গহ্বরে চিৎকার করে ওঠে। একজন অশক্ত মানুষের পাশে কেউ নেই। অসহায় বৃদ্ধাটিকে একটি
শীত কম্বলের জন্য ফিরে ফিরে আসতে হয় বহুদিন। মৃতপ্রায় শিশু কোলে মাকে কেউ সহজে তুলে
দেয় না নূনতম ঔষধের দাম। তার চেয়ে ভালো আমরা বিজ্ঞাপন দেব কিছু হাজার, লক্ষ, কোটি টাকার। বিজ্ঞাপন
দেখব আর আমাদের সুখী ভেবে ঘুমোতে যাব নিশ্চিন্তে।
এসব নিছক কল্পনার অতিমাত্রিক নির্মাণ নয়।
এসব অনির্বাণের অভিজ্ঞতা। উপলব্ধির শেকরে জলবাতাস পায় আর নিজে যন্ত্রণায় ছটফট করে।
উন্নয়নের আকাঙ্খিত শৃঙ্খল ছিঁড়ে কাড়ি কাড়ি টাকা উবে যাচ্ছে অদৃশ্য বেলুনের মতো। সবার
দৃষ্টিতে বিস্ময়। বিস্ময় উপভোগ করো,— হে আমার প্রিয় ঈশ্বরের সন্তানেরা। আর তফাৎ
যাও।
এসবের মধ্যে অনির্বাণ নিজেকে সংযত রাখে এবং
সামাজিক জীব হতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করে! অপর দিকে চড়তে থাকে যন্ত্রণায় পারদ।
এসব ঝেড়ে ফেলে শরীর মন থেকে। নিজের সামর্থ্যরে
মধ্যে দিয়ে আরেকবার ফিরে যায় অরণ্য মানুষের কাছে। যাদের দাবীর মধ্যে নেই কোন শতর্ উলঙঘন।
তবু অনির্বাণ ভাবে পৃথিবীর অসুখ একদিন সেরে
যাবে। সে যুক্তি মেলায়। ইউরোপের পঁচিশ দেশ মিশে গেছে। এরপর অন্যপ্রান্তে যেমন আফ্রিকায়
মিশে যাবে সকল দেশ। এভাবে একদিন অভিন্ন হৃদয় হবে পৃথিবী। মানুষ আনন্দে খেলে বেড়াবে
বিস্তীর্ণ মাঠে। এ অনির্বাণের লালিত বিশ্বাস। কিন্তু নিকট ভবিষ্যতে সভ্যতার বুকে আলোর
দখল নিয়ে চলবে সংঘাত আরো কিছু কাল। আরও বেশি করে কিছু মানুষ বেশীরভাগ লোকেদের ঠেলে
দিতে চাইবে অন্ধকার গুহার দিকে। আলোর উৎসবে যেন শুধু রঙীন পোশাকীদের আমন্ত্রণ।
প্রতিদিনকার ভিন্ন জগতের লড়াইয়ে অনির্বাণ
এগিয়ে যাবার পথ পায় না। পিছু হঠতে থাকে একাকী। পেছনে তার পরিবার। মা-বাবা, ভাই-বোন।
অনির্বাণ থিতু হতে চায় এই জীবনের কাছে। প্রাচীন
টেলিফোন পোষ্টের গায়ে জড়ানো তারে আর হেলান
দেওয়া হয় না অনির্বাণের। সে ধোপদুরস্ত হতে শেখে অন্যদের মত। জীবনের গ্রন্থিত নতুন শেকড়ে
সিঞ্চিত হওয়ার অভাব অনুভব করে। রবিবারের কাগজের পাতা উল্টায়। নিখুঁত চোখে দেখে প্রতিটি
বিজ্ঞাপন। কাউকে কিছু বলে না। শুধু খোঁজে। অনির্বাণ জানে শুধু সে জিজ্ঞাসার মানে।
একদিন আকাঙ্খিত বিস্ময় আলোর মতো অনির্বাণের
হৃদয় আলো করে এলো সুচরিতা। গান জানে। রান্না জানে ভালো। এতসব চাওয়া ছিল অনির্বাণের
উপরি। হঠাৎ মনে পরে, কেউ লিখেছিল— যে মেয়ে রান্না করতে ভালোবাসেনা সে ভালো প্রেমিকা
হতে পারে না। মিলিয়ে নেয় সুচরিতার হাতে সর্ষে ইলিশ ও গুনগুন সুরের ধ্বনি। পুলকিত হয়
অনির্বাণ। সুচরিতা যেন তার ব্যক্তিগত অহঙ্কারে একটা নতুন পালক। প্রেমের জোয়ার এসেছে
অনির্বাণের জীবনে। এ প্রেম তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে দূরতম কোন সবুজ দ্বীপে। যেখানে হারিয়ে
যাওয়া প্রেম ফিরে পাওয়ার অবকাশ থাকবে। যে অভিজ্ঞতার জন্য অনির্বাণ হৃদয় জুড়ে যন্ত্রণার ছটফটানি ছিল
একদিন।
সুচরিতা অনির্বাণকে নিজের মত করে গড়ে নেয়।
অনির্বাণ চেয়ে দেখে। ঢেলে দেয় গলিত নরম লোহার মত। আর ঠোঁটের কোণে ঝুলিয়ে রাখে হাসি।
সে হাসিতে রোমাঞ্চিত হয় সুচরিতা। যে হাসিতে একদিন বর্বর হয়েছিল শুভপ্রিয়া। এই হাসির
আহ্বান দেবদূতের আমন্ত্রণের মত উচ্ছ্বল, স্বচ্ছ নরম। শব্দহীন ইশারায় সুচরিতার বুক কাঁপে। সে অলঙ্কারবিহীন এগিয়ে
যায় অনির্বাণ আগুনের দিকে। অনির্বাণ তাকে পুরে নেয় তার কোটরে। তার ছিন্নভিন্ন অহঙ্কার,
রাগ, যন্ত্রণা— সবকিছু সুচরিতাকে উপহার দিয়ে বলে,— এসো আমরা মাখামাখি
করে বাঁচি এক নতুন প্রশস্ত দিনের সন্ধানে।
––––––––––––––––––
বিবরয়, প্রেম সংখ্যা, ২০০৫
No comments:
Post a Comment