ডুয়ার্স
মাঘের শেষে, ফাল্গুনের অপেক্ষায়
সুচরিতাসু তিস্তা,
কিশোরবেলার সেই নির্মল নীল জল নিয়ে এখনো বহমান
রয়েছ কিনা জানি না। এখনো নীল আকাশে চোখ রেখে উদাসী হও কিনা— তাও জানা নেই। চুলে
সাদা মেঘ খাপছাড়াভাবে উঁকি দিলেও এখনো তোমার জন্য তেমনি কিশোরই রয়ে গেছি। বয়সকে স্থির
বিন্দুতে বেঁধে রেখেছি, তোমার মেহেন্দী-আঁকা নম্র হাতে তুলে দেব বলে। অনেকগুলো বছর খন্ড
খন্ড কষ্ট, অভিমান আর প্রগাঢ় যন্ত্রণা আমার উঠোনে ফেলে রেখে উধাও। তোমাকে
শেষ দেখেছিলাম হালকা আকাশী নীল শাড়িতে। মায়াবী একটা টিপ ছিল দুই ভুরুর মাঝখানে,
একটু উপরে। শুকতারার মতো চোখের মণিতে কিছু গাঢ় মায়াবী অনুপ্রাস। তাচ্ছিল্য আর প্রশ্রয়
মিলেমিশে কেমন এক বিষন্ন কাব্যও ছিল।
কেমন আছো, তিস্তা ? কেমন চলেছে তোমার ঘরকন্না
? অরুণ মিত্র পড়ো এখনো ? ... ‘ কোথাও কিছু ভিজছে/ না, শুধু তোমার স্বর ছলছল
করছে বালি ছাপিয়ে কাঁটার/ আস্তানা ঘিরে। আমি বেলে শিরীষে পা ঘষছি বসছি/নখ দিয়ে মরা
মাটি খুঁড়ছি খুঁজছি কোথায় ছুঁই তোমার/গলার স্রোত।’ (এখনো জলের জন্যে/ অরুণ
মিত্র)। তোমাকে এখনো বড্ড ছুঁতে ইচ্ছে করে, তিস্তা। রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ের
পেলব তুলিতে আঁকা তোমার হাত, বিকাশ ভট্টাচাযোঁর রূপটানে আঁকা তোমার নারীত্ব, যোগেন চৌধুরীর রঙ মাখা
শরীর বড় ছুঁতে ইচ্ছে করে, তিস্তা। এখনো কি তোমার পায়ের পাতায় আংরাভাসার পড়ন্ত রোদ এসে
আলতা পড়ায় ? এখনো কি তোমার বুকের উদ্ধত্তে ভূটানপাহাড় লজ্জারুণ হয় ?
তোমার স্পর্শ এখনো তেমন করেই চাই, তিস্তা। সেই কবে মঞ্জুষ দাশগুপ্তের কবিতা
তোমাকে শোনাতেই, লাল হয়ে বলেছিলে . . . .। এখনো সেই কলিগুলো ঠিকঠাক মনে ধরা আছে—
‘‘
আমার হাত সবটুকু স্পর্শ চায়
খুলে
ফেলো আংটির বাধাটুকুও
সাপের
মিথুন দেখে এসো মাঠে
শিখে
নিও নিবিড়তা কাকে বলে . . .’
এখনো কি তুমি বৃষ্টির পদাবলী শোনো তিস্তা
? বুকের ভেতর কল্কল্ জল বয়ে যায় ? এখনো কি ফেরারী মেঘের জন্য ছাদের কার্ণিশে
দাঁড়িয়ে বেহিসাবী বাতাসের মতো পাগলী হয়ে ওঠো। আমার কথা ভুলেও কখনো ভাবো, মেয়ে ? অথচ ওই চুলের রহস্যময়
সুগন্ধী এখনো গাঢ় হয়ে লেগে আছে। কোথায় ? জানো না তুমি ? জানতে চেয়েছ কোনদিন
? এবার বর্ষায় সব অভিমান শাওনজলে ভাসিয়ে দেবো বলে বসে আছি। গত পরশু হঠাৎ-ই পড়লাম
আমার প্রিয় কবি পূর্ণেন্দু পত্রীর কবিতা— ‘দুঃখ দিয়েছিলে তুমি/আবার লাইটারটাও দিয়েছিলে।
/বোতাম ছিঁড়ে আমাকে নগ্ন করেছো তুমি/ আবার বুনে দিয়েছো নাইলনের সবুজ জামা।/ কমলালেবু
নিংড়ে নিংড়ে বানালে সরবত/ভিতরে মিশিয়ে দিলে গোপন কান্নাকাটি/ স্মৃতির পেস্তা-বাদাম।/
সেই সরবত এখন খেতে হবে প্রত্যহ, / বাইশ বছরের যুবকটা যতদিন আমার/চুলের ভিতরে আঁচড়াবে/আগুন রঙের
চিরুণি।’’ (দুঃখ দিয়েছিলে তুমি/ পূর্ণেন্দু পত্রী)
হয়তো কবিতা পড়োই না এখন, কিংবা খাপছাড়া পড়তেও
পারো, হয়তো কবিতার পৃষ্ঠায় আচমকা আমার মুখ! (এখনো কী দুঃসাহস দ্যাখো!)
‘
আমাতে আমি ছিলাম, নাকি তোমাতে গেছি মিশে
সেদিন
? পড়ে মনে ?
আজও
তো আমি পুড়ছি সেই দিনের স্মৃতিবিষে
কারণে
অকারণে।’
(প্রাক্তনী/পবিত্র
মুখোপাধ্যায়)
তিস্তা, আমার নদী, আমার মৃত্যু-তটিনী,
তোমার রূপকথা কিভাবে পোড়াই ? যতবার সেই অক্ষরবিন্যাসে আগুন দিতে যাই, ততবার নিজেই পুড়ে ছাই।
অথচ, বন্ধু, আমার কথাগুলো কত স্বচ্ছন্দ
ছিল; এখনো তোমার বাংলা বইয়ের মলাটের নীচে খুঁজে দেখো, খুঁজে পাবে মহার্ঘ্য
চিরকুট— কাঁপা হাতে কবিতার মুখ—
‘আমাকে তোমার কাছে রেখে
যেতে চাই।
যত
মতিচ্ছন্ন দিবা, চাঁদকপালী অন্ধকার, ন দী
সব
তোমার জন্যই রেখে যেতে চাই। . . .’
সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত’কে চুরি করে যে কিশোর
মেলেছিল মন, সে আজো চৌর্যের জন্য অনুতপ্ত নয়।
তিস্তা, আমার গোপন দুঃখ,
তোমার চোখের তারায় এখনো কি লেগে থাকে বৃষ্টিবুনট অভিমান? এখনো কি প্রতীক্ষা
করো একটি আচমকা-সাইকেল বেলের ? মধ্য-দুপুরের জানালার শিকে এখনো কি তোমার ঘামভেজা হাতের স্পর্শ
? এখনো কি অপরাহ্নে চা-বাগানের ওই সর্পিল রাস্তা ধরে মনে-মনে হাঁটো ? হেঁটে যাও ?
আমি ভাবতেই পারিনা— তোমার দিনশেষের অপেক্ষার
আকুল সিঁড়ি বেয়ে মোজাইক মেঝেতে অন্য পুরুষের পা। অথচ তোমার ছোট্ট মেয়েকে আমি মনে মনে
আদর করি। ওর জন্য কল্পকথার গল্প বানাই। তোমার মেয়ে কি তোমার মতোই দেখতে হয়েছে ?
কি নাম রেখেছ ওর ? তোর্ষা, মহানন্দা নাকি ডায়না ? নদীর মেয়ে তো নদীই
হবে, তাই না ?
বয়স গড়িয়ে যাচ্ছে, তিস্তা। শেষপারানির
কড়ি শূন্যই থেকে যাবে, তাও জানি। তবু আবেগতাড়িত হই। আমি তোমাকে স্পর্শ করিনি কোনদিন।
কোনদিন চোখের পাতায় আঁকিনি কামনার দাগ। কোনদিন শরীর-এর দিকে তাকিয়েও দেখিনি। কারণ—
তোমার দিকে তাকালেই আমার চেতনায় পবিত্র ধূপের গন্ধ.... মাঙ্গলিকী... স্বর্গমাধুরী....। তোমার একটি ছবি আমার কাছে নেই। অথচ পাঁচ হাজার অ্যালবাম
তোমার ছবিতেই ভরা ! একমাত্র আমিই দেখতে পাই, তুমি হাঁটছো,
বসে আছো, ঘুমোচ্ছো, আবার কাঁদছোও। অথচ তোমায় ছুঁতে পারিনা, তিস্তা।
গতকাল হঠাৎ-ই পড়লাম আবু কায়সার-এর কবিতা।
ওপার বাংলার। উনি কিভাবে আমার কথা জানলেন ?
‘আমি তো ভালো অনুবাদক
নই
তোমার
মুখ আঁকতে গিয়ে সই
আপন
বর্ণ আপন বর্ণমালা
তাতেই
গাঁথি বিনে সুতোর মালা।
গ্রাম্য
পথ, কর্দমাক্ত ঘাটে
তোমাকে
নিয়ে পড়েছি বিভ্রাটে।’
ভালো
থেকো। সবাইকে ভালো রেখো।
ইতি—
তোমার
. . . . . . . .।
বিবর, এপ্রিল ২০০৫ । বিবর আয়োজিত প্রেমপত্র লেখা প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার প্রাপ্ত চিঠি। পুরস্কার মূল্য : দেড় হাজার টাকা।
No comments:
Post a Comment