পুজো উপলক্ষে প্রতি বছরের মতো এবারও মেলা বসেছে। উজ্জ্বল
শ্যামবর্ণা, হাল্কা গোলাপী রঙের ছাপা শাড়ি, ম্যাচিং ব্লাউজ আর নিটোল দুখানা হাত। হাতে সরু দুখানি চুড়ি। মাথায় একরাশ চুল, এলোমেলো খোঁপা বাঁধা। দেখতে খুব খারাপ না। মুকুল দেখছিল মেয়েটিকে।
মুকুলের ছোট্ট মনোহারী দোকানের জিনিসপত্র খুঁটিয়ে দেখছিল
মেয়েটি। কী কিনবে ভেবে পাচ্ছিল না হয়তো। দোকানটা খুব সুন্দরভাবে সাজিয়েছে
তার। যদিও দুইদিনের মেলা, তবুও মাঠের মধ্যে সার সার সাজানো অন্যান্য মনোহারী দোকানগুলোর তুলনায় তার
দোকানটি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। মেলার প্রথম দিন ভাল বিক্রিবাট্টা হয়েছে
কিন্তু এই মেয়েটি — ভাবতে ভাবতে মুকুল পিছনে রাখা টিনের বড় ট্রাঙ্কের গায়ে হেলান দিয়ে বসল।
দুটি মধ্যবয়সী বউ হাতে ধরা ছেলেমেয়েদের নিয়ে দোকানে এল।
দুটো খেলনা পিস্তল, ছোট্ট প্লাস্টিকের ব্যাটবল, মোটরগাড়ি, বেলুন, সিন্দুরের কৌটো, চিরুণী আর ছোট আয়না কিনে নিয়ে গেল। ভীষণ দরাদরি করেছে। বলতে গেলে প্রায় কেনা
দামে দিতে হয়েছে ঐ সব জিনিস। কিন্তু মেয়েটি
নট নড়নচড়ন। এক মনে তার দোকানের প্রতিটি জিনিস দেখছে...।
আচ্ছা, মেয়েটির কাছে কী টাকা পয়সা নেই ? তাহলে দোকানের সামনে মিছিমিছি দাঁড়ানো কেন ? মেলায় ঘুরে ফিরে
বেড়াক। চেহারা দেখে তো মনে হয় কোন সম্পন্ন বাড়ির মেয়ে। দোকানের জিনিসপত্র দেখছে, দুচোখ ভরে আশ মিটিয়ে দেখুক, তাতে তার কিছু এসে যায় না। তবে দোকানের
সামনে মাঝামাঝি যেভাবে দাঁড়িয়ে দেখেছে তাতে অন্য খদ্দেরদের অসুবিধা হতে পারে।
— কী নেবেন ? দোকানী সুলভ মৃদুস্বরে জানতে চাইল মুকুল।
— দেখছি... কী নেওয়া যায় ! এক টুকড়ো মিষ্টি হাসি ছুঁড়ে দিল মেয়েটি।
— আমার দোকানের সব জিনিসই উচ্চমানের। খাঁটি। কোন জিনিস দুনম্বর নয়। পাউডার, লিপিস্টিক, নেলপালিশ, স্নো, চিরুণী, আয়না, আলতা...
— ওসব কিচ্ছু না ! মুকুলের তোতাপাখির মতো আউরে যাওয়া নামগুলির মাঝে মুচকি হাসল
মেয়েটি।
মুকুল একটু অবাক হল। মনে মনে বিরক্ত। এই বিক্রিবাট্টার সময়
দোকানের সামনে খামোকা দাঁড়িয়ে থাকা আর যাই হোক, মা লক্ষ্মীর ভক্তদের
আনাগোনায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করবে। ব্যাজারমুখে মেয়েটির দিকে তাকাতেই হঠাৎ চোখাচোখি।
মেয়েটি তার দিকে তাকিয়ে আছে অপলক !
— হেয়ারপিন আছে ?
মুকুল যেন আকাশ থেকে পড়ল। হে-য়া-র-পিন! এতক্ষণ ধরে তাহলে এই
জিনিস খোঁজ হচ্ছিল ? ঘাড় নেড়ে নিরাসক্ত গলায় উত্তর — না, নেই। ফিক্ করে হেসে ফেলে মেয়েটি। নির্মল সাদা ঝক্ঝকে দাঁত। দুষ্টু চোখে হেসে
বলল, সবই যখন রেখেছেন
হেয়ারপিন রাখেননি কেন ?
চমকে তাকাল মুকুল। বাবা ! এ যে সাংঘাতিক মেয়ে! আমতা আমতা
গলা বলল, ইয়ে মানে ... পরশুদিন ধরমপুর হাটে সব বিক্রি হয়ে
গেছে...। মুখে আঁচল চাপা, অবিশ্বাসী চোখে কিছুক্ষণ হাসল নিঃশব্দে, তারপর আবার দেখতে লাগল জিনিসপত্র। ঠিক সেই সময় এক ভদ্রলোক এসে ডাকল মেয়েটিকে।
— কী রে লক্ষ্মী, তোর জিনিস পেয়েছিস ?
— উঁহু, পাইনি জামাইবাবু। চোরা চাউনি মুকুলের চোখে রেখে বলল লক্ষ্মী।
ঠোঁটে হাসি।
মুকুলের দিকে তাকাতেই ভদ্রলোক বিস্মিত হয়ে বললেন, আরে ! আপনি মুকুল সাহা না ? দেবীগঞ্জের বীরেনবাবুর মেজ ছেলে...।
— হ্যাঁ, বাবাকে চেনেন ?
মুকুল হ্যাজাকের আলোয়
খুঁটিয়ে দেখার চেষ্টা করল।
—
বিলক্ষণ চিনি। আমি
আন্তিনগরের গোকুল মন্ডল। আপনার বাবাকে বলবেন। তারপর মেয়েটিকে ইঙ্গিতে কী যেন
বললেন। মৃদু ধমকের সুরে লাজুক হেসে মেয়েটি বলল, ভাল হবে না বলছি...।
—
আমার ছোট্ট শালি, মেলায় বেড়াতে এসেছে। চল রে লক্ষ্মী। তারা চলে গেল।
লক্ষ্মী ! নামটা কেমন শোনা শোনা লাগছে মুকুলের। গোকুল
মন্ডলের শালী। হঠাৎ মুকুল উত্তেজনায় সোজা
হয়ে বসল। হ্যাঁ, মনে পড়েছে তার। এই গোকুলবাবুই তো বিয়ের ঘটকালি
করছিলেন ওনার শালীর জন্য।
মুকুল বি.এ পাশ করে কোথাও চাকরি না পেয়ে মনোহারী দোকানের
ব্যবসা ফেঁদেছিল গতবছর। দোকানটা ঠিক না দাঁড়া করানো পর্যন্ত বিয়ে করতে চায়নি।
কিন্তু বাবার পীড়াপীড়িতে একদিন হঠাৎ সে চলে গিয়েছিল
মেয়ে দেখতে। ওর বন্ধু ফটিকের সাথে। সে শুনেছিল মেয়েটির গায়ের রং চাপা তবে বুদ্ধিমতী
এবং উচ্চমাধ্যমিক পাশ। ফটিকের পিসির বাড়ি শান্তিনগর কলোনীতেই। খাওয়া দাওয়ার পর
ফটিকের পিসির বাড়িতেই সন্ধ্যাবেলা গোকুলবাবুর শালীকে ডেকে এনেছিল ছলছুতায়। লক্ষ্মী
দূরসম্পর্কে ফটিকের খুড়তুতো শালী। লণ্ঠনের অল্প আলোয় লক্ষ্মীর ঢিলেঢালা খোঁপা
দেখে মুকুল ইয়ার্কির ছলে বলেছিল— কীরে ফটিক, তোর শালীর কি একটা হেয়ারপিনও জোটে না নাকি ? মুকুলের কথায় লক্ষ্মী চমকে উঠেছিল। সে খেয়াল করেনি এতক্ষণ, ফটিক ছাড়াও আরও একজন আছে। ফটিকের ডাকে সে নিছক আটপৌড়ে শাড়ী পড়েই এসেছিল।
ফটিকের পিসির বাড়ির গা ঘেঁষে লক্ষ্মীদের বাড়ি।
লোকটি কে ? লক্ষ্মী মুকুলকে দেখার চেষ্টা করেছিল আবছা আলোয়। ফটিক
লণ্ঠনের পলতে উসকে ধরেছিল মুকুলের মুখে। ফটিক আর মুকুলের অর্থপূর্ণ হাসি এবং
ইঙ্গিত দেখে সে যা বোঝার বুঝেছিল। পালিয়ে গিয়েছিল এক দৌড়ে। পরে লক্ষ্মী সব জানতে
পারে। ফটিকের পিসির মুখে শোনে ছেলেটার নাম মুকুল। বি.এ পাশ। চাকরী না পেয়ে মনোহারী
জিনিসের দোকান দিয়েছে। হাটেঘাটে, মেলায় দোকান দেয়। ভাল বিক্রি হচ্ছে। তবে
এখন বিয়ে করবে না। লক্ষ্মীকেই দেখতে এসেছিল।
তাহলে এই জন্য কি মেয়েটি, উঁহু লক্ষ্মী তার
দোকানে দাঁড়িয়েছিল... স্রেফ হেয়ারপিনের ছুতোয় ! মোক্ষম জবাব দিয়েছে তাকে মেয়েটি।
নিষ্ফল আক্রোশে আর লজ্জায় মুকুলের নিজের হাত কামড়াতে ইচ্ছে করছিল। ইস্ আগে যদি
জানতে পারত...।
দোকানে তখন অনেক খরিদ্দার ভীড় করেছে। নানা চিৎকার আর মাইকের জোরালো শব্দে গম গম করছে মেলা, কিন্তু মুকুলের সেদিকে হুঁশ নেই। সে তখন ভাবছে লক্ষ্মীর কথা। মেয়েটি দেখতে
মন্দ নয়।
সে মনে মনে ঠিক করল আগামীকাল শহরে গিয়ে মহাজনের কাছ থেকে
কয়েক বা-িল হেয়ারপিন কিনে আনবে। তার থেকে এক প্যাকেট হেয়ারপিন ফটিকের মারফৎ লক্ষ্মীকে পাঠাবে। সত্যি তো, তার দোকানে সব আছে। নেই শুধু হেয়ারপিন !
উত্তর দিনাজাপুর জেলা বইমেলা স্মরণিকা––২০১৩
1 comment:
দুর্দান্ত একটি মিষ্টি প্রেমের গল্প
Post a Comment